হিল ভয়েস, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (সিএইচটি কমিশন) কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান মামলায় অভিযুক্ত অপরাধীদের বাদ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনটি আদালত কর্তৃক গ্রহণের বিষয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এছাড়া কমিশন অন্তত একবার এবং পূর্ণ মাত্রায় আইনের আওতায় সকল দায়ী পক্ষগুলির জবাবদিহি নিশ্চিত করে জরুরি ভিত্তিতে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে তার কর্তব্য পরিপূরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।
আজ (২৮ এপ্রিল) কমিশনের তিন কো-চেয়ার সুলতানা কামাল, এলসা স্টামাটোপোলো ও মিরনা কানিংহাম কাইন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিবৃতিতে এই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, আদিবাসী অধিকার কর্মী কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান বিষয়ে রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক প্রদত্ত সাম্প্রতিক রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন গভীরভাবে দুঃখিত এবং হতাশ। রাঙ্গামাটির জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার তত্ত্বাবধানে আদালত কর্তৃক পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট গ্রহণের সিদ্ধান্ত, যেখানে সকল সন্দেহভাজনদের রেহাই দেওয়া হয়েছে, আমাদেরকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর, ১২ জুন ১৯৯৬ সালে যখন পার্শ্ববর্তী একটি সেনা ক্যাম্পের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির নিউ লাল্যাঘোনায় তার দুই ভাই সহ বন্দুকের নলের মুখে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ভাইয়েরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অপহরণকারীরা কল্পনাকে ধরে নিয়ে যায়।
পালানোর পূর্বে, কল্পনার ভাইয়েরা অপহরণকারীদের অন্তত তিনজনকে চিনতে সক্ষম হন: কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের তৎকালীন লেঃ ফেরদৌস এবং ভিলেজ ডিফেন্স পার্টির (ভিডিপি) দুই সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমেদ। পরবর্তীতে কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগ নেন, কিন্তু বিচার ব্যবস্থা বরাবর পরিবারটিকে সুকৌশলে এড়িয়ে চলে। দীর্ঘ বছর ধরে ৩৮ জন কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলাটির তদন্ত হয়, যারা কোনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হন।
ইহা এক হতাশাজনক পর্যায় যে, ২০১৬ সালে ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার সৈয়দ তরিকুল হাসান কর্তৃক দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদন অপহরণের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে ব্যর্থ হন। কল্পনার ভাই অভিযোগ করেন যে, তদন্ত চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তাদের দ্বারা অভিযুক্ত কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি; বরং তদন্ত প্রক্রিয়া ও বিচার ব্যবস্থা কর্তৃক কল্পনার ভাইদের ও পরিবারকে হয়রানি করা হয়।
ভুক্তভোগী পরিবার চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে একটি নারাজি আবেদন দাখিল করেন, এবং তখন থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি আবেদন চলমান ছিল, যখন আদালত বাদীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২০১৬ সালে দাখিলকৃত প্রতিবেদনটি মেনে নেন, যারা মাধ্যমে সকল অভিযুক্ত অপরাধীদের বাদ দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৬ সালের প্রতিবেদন মেনে নেওয়া এবং সকল অভিযুক্ত অপরাধীদের অপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়ার আদালতের সিদ্ধান্ত আমাদেরকে গভীরভাবে হতাশ করেছে। অধিকতর তদন্তের নির্দেশ প্রদানের চেয়ে বরং আদালত কর্তৃক অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন গ্রহণের দ্বারা কমিশন মর্মাহত হয়েছে। এই রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে কেবল জোরদার করেনি, উপরন্তু অভিযুক্ত অপরাধীদের প্রদত্ত পরিকল্পিত সুরক্ষা ব্যবস্থাকেও উন্মোচন করেছে, বিশেষ করে যদি তারা সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়। এমনকি জবাবদিহির আওতায় আসার পরিবর্তে, অভিযুক্ত অপরাধীদের অন্যতম লেঃ ফেরদৌসকে ঘটনার পরে মেজর পদে উন্নীত করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে চাকরি করেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন এই বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতায় দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানায় এবং ইহাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিচার ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে ভঙ্গুর বিশ্বাসের প্রতি একটি কঠিন আঘাত হিসেবে দেখছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৩ ও ৯(১) অনুচ্ছেদ এবং নারীর উপর সহিংসতা দূরীকরণ বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কল্পনা চাকমার সুবিচার নিশ্চিত করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।