হিল ভয়েস, ১১ এপ্রিল ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল ১০ এপ্রিল ২০২৪, সকাল ৯:৩০ টায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণে প্রতিবছরের ন্যায় এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মদের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, চাংক্রান, বিহু’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘জুম্মদের সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে অধিকতরভাবে এগিয়ে আসুন’ শ্লোগান নিয়ে এইসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, চাংক্রান, বিহু-২০২৪ উদযাপন কমিটি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক, অব:উপসচিব শ্রী প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা এবং উদ্বোধন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা, বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক শিশির চাকমা, গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি জয়তী চাকমা। অনুষ্ঠাবে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টুমনি তালুকদার।
উদ্বোধক ও অতিথিবৃন্দ প্রথমে বেলুন উড়িয়ে এবং গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীদের পরিবেশেনায় বিভিন্ন জাতির নৃত্য ও সংগীত প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, আমাদের মূল মূল রীদি-সুদোমগুলো (রীতি-প্রথা) আমরা যদি ধরে রাখতে না পারি, তাহলে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতি হিসেবে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আমাদের পুরনো অনেক রীতি ছিলো, যাতে সেগুলো আমরা তথাকথিত অতিআধুনিকতা বা অতিশিক্ষিত হয়ে যেগুলো আমাদের মূল কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ সেগুলো যেন আমরা ভুলে না যায়। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, মাঝেমধ্যে সারা দেশেও কিছু বাইরের সংস্কৃতি ভালোভাবে না বুঝে আমরা মেনে নিয়ে আমাদের প্রাচীণ যেটা ভালো সেটা ভুলে যায়।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় এখন বিষুব সংক্রান্তি শব্দ খুঁজে পাওয়া কষ্ট, পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত উড়িষ্যাতে পাবেন। এই বিষুব সংক্রান্তির বিষুব থেকেই তো বিজু, বিষু, বিহু, বৈসু এবং ম্রোদের চাংক্রান, মারমাদের সাংগ্রাই। এই তো বিষুব সংক্রান্তি। একটা সম্মিলন গ্রহ-নক্ষত্রের, বিষুব রেখার।
তিনি আরও বলেন, আমার সুযোগ হয়েছিল, মাস দেড়েক আগে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার, এখানকার অন্যতম জ্যেষ্ঠ সামাজিক নেতা সম্মানিত গৌতম দেওয়ানকে সাথে নিয়ে। আমরা দু’জন মনখুলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের বঞ্চনার কথা, আমাদের দুঃখের কথা শুনিয়েছি এবং তাঁর ধৈয্যের জন্যে, সহানুভুতির জন্যে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমি এমনও বলেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের অঞ্চলে এখন পাতানো খেলা চলে। মাঝেমধ্যে কৃত্রিমভাবে সংঘাতের নাটক সাজানো হয়। এইসব নাটকের যদি অবসান না হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হতে পারবে না। জুম্ম হিসেবে, আদিবাসী হিসেবে, পাহাড়ি হিসেবে, বাংলাদেশি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো না।
তিনি বলেন, আমাদের যেমন বঞ্চনা রয়েছে, আমাদের আশার কথাও বলতে হবে। যারা তরুণরা রয়েছে, যারা কিশোরীরা রয়েছে, শুধু যদি বলি যে, আমাদের বঞ্চনার কথা, তাহলে তারা নিরাশ হয়ে যাবে, তারা সংগ্রাম করতে পারবে না। আমি মনেকরি যে, আমরা অবশ্যই যারা বঞ্চিত তাদের পাশে দাঁড়াবো, অন্যায় হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলবো। কিন্তু আমাদের আশার বাণীও শোনাতে হবে, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের স্বকীয়তা নিয়ে, তাদের শক্তি, তাদের উদ্যম নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
উদ্বোধক নিরূপা দেওয়ান বলেন, আমরা প্রতিবছর এখানে সমবেত হই। এই বিজুটা আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয় ঐক্য। আমরা চেষ্টা করি বা আমাদের চেষ্টা করতে হয়, আমাদের যে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আছে, আমাদের যে রীদি-সুদোম (রীতি-প্রথা) আছে, সেগুলোকে সমুন্নত রাখার।
তিনি বলেন, এই বিজুটা শুধু আনন্দের দিন নয়। শুধু খাওয়া-দাওয়া করে আনন্দ করবো তা নয়। এই বিজুটা আমাদের আত্মদর্শনেরও দিন। আমাদের আত্মদর্শন ও আত্মোপলব্ধিও করতে হয়। আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সাহিত্য, আমাদের যে মূল শেকড়, যদি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়, তাহলে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না, আমাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না। সবাই মিলে সবাইকে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো সৃদৃঢ় করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এই উৎসবে আমাদের কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই মিলে তা উদযাপন করতে চাই। সবাই মিলে অনাবিল আনন্দ নিয়ে যদি আমরা এই উৎসব পালন করি তবেই তা সার্থক হবে। তবে আমি অনুরোধ করবো, আনন্দের অজুহাতে আমরা যাতে সীমা লংঘন না করি। অনেক সময় দেখা যায়, আনন্দ করতে গিয়ে আমরা উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িয়ে পড়ি।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি ঊষাতন তালুকদার বলেন, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু আমাদের ঐতিহ্য, আবেগ, উচ্ছাস ও জীবনের সাথে মিশে আছে। কিন্তু আগের মত জীবনকে সেভাবে উপভোগ করার সময় বা অবকাশ এখন আর নেই। আজকে যেন মনে হয়, এখানে আসার প্রয়োজন আছে, এসেছি। প্রাণখোলাভাবে, উন্মুক্তভাবে, মনপ্রাণখুলে, হেসেখেলে আসতে পারি নাই। যারা নেচেছে তাদেরও, আমি মনেকরি, সবার মনে একটা উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, নিরাপত্তাহীনতাবোধ বিরাজ করছে। পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছর পরেও এখনো কেন যেন মনে হয়, আমাদের জীবন আমাদের নয়। কারোর দ্বারা এটা পরিচালিত।
তিনি বলেন, মানুষ পৃথিবীর সেরা জীব। আজ সভ্যতা অনেক এগিয়েছে। কিন্তু তবু আজকে কেন হানাহানি? কেন আজকে গাজায় ৩৪ হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে? শিশু, নারী কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে! আজকে পাহাড়ের মানুষের মুখ দেখেন। আমরা তো খোলামেলাভাবে হাসতে পারি না। কেন? এই কেন’র উত্তর পেতে আমাদের সরকারকে, নীতি-নির্ধারকদের এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের ভাবা উচিত।
তিনি আরও বলেন, কাউকে পেছনে ফেলে রেখে এই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, সোনার বাংলা হবে, কিন্তু সবাইয়ের নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকে ইগো নয়, জাত্যভিমান নয়, এগিয়ে আসুন। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আজকে আমরা বান্দরবানে কী দেখেছি? ১৮ জন মহিলা এখন কারাগারে। সেখানে অস্ত্র লুট হয়েছে ১৪টা। কেন এই অবস্থা দাঁড়াচ্ছে? আরো অনেক কিছু দেখবো হয়ত। সেটা আশা করি না।
তিনি বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশি। এই বাংলাদেশে সকলের মিলিতভাবে উন্নয়ন হবে। মাথা উঁচু করে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা বাংলাদেশের শত্রু নয়, বাংলাদেশের পথের কাঁটা নয়। জুম্মরা, বাংলাদেশের আদিবাসীরা বরং বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে। বরং দেশের মানসম্মান তারা বাইরে থেকে নিয়ে আসে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সকাল ১১:৩০ টার দিকে পৌরসভা প্রাঙ্গণ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার বহর করে, বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্যবাদী বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীত পরিবেশন সহ একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয় এবং র্যালিটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এসে সমাপ্ত হয়।
প্রতিবিছরের ন্যায় উদযাপন কমিটি এবছর তিন দিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মধ্যে অন্যতম হল- ১০ এপ্রিল, বিকাল ৩টায় চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যা ৬টায় আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ, ১১ এপ্রিল, সকাল ১০টায়, রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়ামে আদিবাসী জুম্ম খেলাধুলা, বিকাল ৩টায় বলি খেলা, সন্ধ্যা ৬টায় কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১২ এপ্রিল, সকাল ৬:৩০ টায় ফুল নিবেদন অনুষ্ঠান, জমায়েত-রাজবন বিহার স্বর্গঘর, ফুল নিবেদন স্থান-রাজবন বিহার পূর্বঘাট।