হিল ভয়েস, ১৩ মার্চ ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলাধীন জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন প্রত্যন্ত দু’টি গ্রামের আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীরা উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী একটি গ্রামের ১২ পরিবারকে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছে এবং দুটি গ্রামের অন্তত ১৭ পরিবারকে তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন জুমচাষের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বলে জানা গেছে।
একাধিক সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী ঐ এলাকায় সীমান্ত সড়ককে কেন্দ্র করে তাদের একচ্ছত্র পর্যটন ব্যবসার বিকাশ ও সেনা আধিপত্য জোরদারের লক্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং স্থানীয় জুম্মদের মৌলিক ও মানবাধিকারকে লংঘন করে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে দুই গ্রামের অধিবাসীকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হলে এবং উক্ত দুই গ্রাম উচ্ছেদ হলে, এর সাথে সাথে শুক্করছড়ি, চঙরাছড়ি, বিলাইছড়ির মন্দিরাছড়া ও জুরাছড়ির মন্দিরাছড়া ইত্যাদি গ্রামগুলিও উচ্ছেদ হতে বাধ্য হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন পাশাপাশি ভুক্তভোগী দুইটি গ্রাম গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া। তবে গাছবাগান পাড়া গ্রামটি জুরাছড়ি উপজেলাধীন দুমদুম্যা ইউনিয়নে এবং থুম পাড়া গ্রামটি বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। গাছবাগান পাড়া এলাকায় রয়েছে সেনাবাহিনীর চাইচাল সেনা ক্যাম্প। সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই চাইচাল সেনা ক্যাম্প জুম্মদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
গ্রামবাসীর সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মার্চ ২০২৪ চাইচাল সেনা ক্যাম্পের সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল গাড়িযোগে গাছবাগান পাড়া গ্রামে উপস্থিত হয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া গ্রামবাসীদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে একটি সভা করে। এসময় সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের ১২ পরিবারকে অচিরেই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং তা না হলে আগামীতে খারাপ সময়ের সম্মুখীন হতে বলে হুমকি প্রদান করেন। এসময় সেনা সদস্যরা আরো জানিয়ে দেয় যে, তারা থুম পাড়া ও গাছবাগান পাড়ার মধ্যবর্তী পিলার চুগ ও লাঙেল টিলাতে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করবে, তাই সেখানে ও আশেপাশের এলাকায় জুম কাটা যাবে না এবং ইতোমধ্যে কাটা জুমগুলোতে আগুন দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এই দুই গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় জুমচাষ করা যাবে না।
এর পরদিনই (গত ১১ মার্চ) সেনাবাহিনী এক্সকেভেটর দিয়ে পিলার চুগ ও লাঙেল টিলায় মাটি কাটা শুরু করে এবং বুদ্ধলীলা চাকমার কাটা জুম ধুলিসাৎ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এর পূর্বে গত ৬ মার্চ সেনাবাহিনী বীরসেন তঞ্চঙ্গ্যার কাটা জুম এক্সকেভেটর দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
সর্বশেষ গতকাল (১২ মার্চ) চাইচাল সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন কবির ও সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) থুদো চাকমার বাড়িতে গিয়ে জুমের তালিকা চেয়েছেন বলে জানা যায়। তবে ভয়ে কার্বারি থুদো চাকমা জুমের তালিকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এসময় ক্যাপ্টেন কবির কার্বারি থুদো চাকমাকে বলেন, ‘তালিকা দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে, না দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে। অতএব, তালিকা দিয়ে কিছু ক্ষতিপূরণ নিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে যাও। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কারো কখনও লাভ হয় নি। অতএব, সরকারের বিরুদ্ধে না গিয়ে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।’ এসময় ক্যাপ্টেন কবির গতকালকের রাতের মধ্যে জুমের তালিকা ক্যাম্পে গিয়ে জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে যান।
সেনাবাহিনী কর্তৃক উচ্ছেদের নির্দেশ পাওয়া গাছবাগান পাড়ার পরিবারগুলো হল- (১) বুদ্ধলীলা চাকমা, পীং-মৃত মদন্যা চাকমা, (২) লেংপাদ চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, (৩) ফরকধন চাকমা, পীং-দিনমোহন চাকমা, (৪) অমর জীবন চাকমা, পীং-ফরকধন চাকমা, (৫) পেন্দুগুলো চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, (৬) বাত্যে চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, (৭) পূন্যলাল চাকমা, পীং-বৃদ্ধলীলা চাকমা, (৮) নিজিমুনি চাকমা, পীং-রবন্য চাকমা, (৯) ভদাং চাকমা, পীং-জক্কা চাকমা, (১০) সাত্তো চাকমা, পীং-মুলো বাব চাকমা, (১১) থুদো কার্বারি, পীং-মুরুঙ্গে চাকমা, (১২) সেবক্কে চাকমা, পীং-নাগা চাকমা। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া এই গ্রামবাসীরা বর্তমানে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে। তারা কার কাছে গেলে, কী করলে প্রতিকার পাবে, তা বুঝতে পারছে না। কারো কাছে গিয়ে জানাতেও ভয় পাচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
অপরদিকে জুম কেটেও যারা সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে জুমচাষ করতে পারছে না সেই পরিবারগুলো হল- (১) তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা, পীং-চিন্তাহরণ চাকমা, গ্রাম-থুমপাড়া, (২) ছক্কো চাকমা,পীং-বিরাজমোহন চাকমা, গ্রাম-থুমপাড়া, (৩) মদন চাকমা, পীং-জ্ঞানলাল চাকমা, গ্রাম-থুমপাড়া, (৪) সুবিমল চাকমা, পীং-রমনী কুমার চাকমা, গ্রাম-থুমপাড়া, (৫) দয়ালাল চাকমা, পীং-ভগবান চাকমা, গ্রাম-থুমপাড়া, (৬) বুদ্ধলীলা চাকমা, পীং-মৃত মদন্যা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (৭) লেংপাদ চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (৮) ফরকধন চাকমা, পীং-দিনমোহন চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (৯) অমর জীবন চাকমা, পীং-ফরকধন চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১০) পেন্দুগুলো চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১১) বাত্যে চাকমা, পীং-বুদ্ধলীল চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১২) পূন্য লাল চাকমা, পীং-বুদ্ধলীলা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১৩) নিজিমুনি চাকমা, পীং-রবন্য চাকমা, (১৪) বদাং চাকমা, পীং-জক্কা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১৫) সাত্তো চাকমা, পীং-মুলো বাব চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া, (১৬) থুদো কার্বারি, পীং-মুরুঙ্গে চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া ও (১৭) সেবক্কে চাকমা, পীং-নাগা চাকমা, গ্রাম-গাছবাগান পাড়া।
জানা গেছে, গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ায় বর্তমানে ২৩টি জুম্ম পরিবার বসবাস করছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরপরই ১৯৯৮ সাল থেকে এই জুম্ম পরিবারগুলো সেখানে বসতিস্থাপন শুরু করে। তাদের প্রধান জীবিকা জুমচাষ। তবে বিগত ২৪/২৫ বছরে তাদের অনেকেই কলাবাগান, আম-কাঠাল বাগান, ঝাড়–ফলের বাগান গড়ে তুলেছে। জুমে অনেকে ধানচাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, তিল, মরিচ ইত্যাদি চাষও করে থাকে।
সেনাবাহিনীর জুমচাষে নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে জুম্ম পরিবারগুলো অত্যন্ত দিশেহারা অবস্থায় পড়েছে বলে জানা গেছে। তাদের বাড়ি, ভূমি ও জীবিকা রক্ষায় তারা সকলের সহযোগিতা করেছে।
উল্লেখ্য যে, গত ৮ মার্চ ২০২৪ বিকাল আনুমানিক ৩ টায় হেলিকপ্টার যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ চাইচাল সেনা ক্যাম্পে সফরে গিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর পরের দিনই (৯ মার্চ) চাইচাল ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা গ্রামে গিয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার জুম্ম গ্রামবাসীদের এই মর্মে জানিয়ে দেন যে, সেনা প্রধানের নির্দেশ জুমচাষ বন্ধ করতে হবে এবং গাছবাগান পাড়ার ১২ পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।