হিল ভয়েস, ১৯ মার্চ ২০২৪, রাঙ্গামাটি: সেনাবাহিনীর ২৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্রিগেড কর্তৃক জুরাছড়ি-বিলাইছড়ির সীমান্তবর্তী গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া উচ্ছেদ বন্ধের দাবিতে রাঙ্গামাটিতে দুই গ্রামবাসী মানববন্ধন এবং প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে।
আজ মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দক্ষিণ ফটকে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। দুলু পাড়ার কাবার্রী অজিত কুমার চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন থুম পাড়ার বাসিন্দা মদন বিকাশ চাকমা, দুলু পাড়ার বাসিন্দা পূন্যরানী চাকমা। এছাড়াও মানববন্ধনে সংহতি বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক উলিসিং মারমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টু মনি তালুকদার ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা।
মানববন্ধন শেষে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ৪টি দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার পাহাড়ি অধিবাসীদের পক্ষে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর প্রদান করেন অজিত কুমার চাকমা, মদন বিকাশ চাকমা, চিবোক্ষ চাকমা ও পূন্যরাণী চাকমা। ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সজল চাকমার সঞ্চলনায় স্মারকলিপি পাঠ করেন বৃষ্টি চাকমা।
স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, সেনাবাহিনী ঐ এলাকায় সীমান্ত সড়ককে কেন্দ্র করে তাদের পর্যটন ব্যবসার বিকাশের লক্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং স্থানীয় জুম্মদের মৌলিক ও মানবাধিকারকে লংঘন করে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে দুই গ্রামের অধিবাসীকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং দুটি গ্রামের ১৭ পরিবারদেরকে তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন জুমচাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হলে এবং উক্ত দুই গ্রাম উচ্ছেদ হলে, এর সাথে সাথে শুক্করছড়ি, চঙরাছড়ি, দুলুবাগান, বিলাইছড়ির মন্দিরাছড়া ও জুরাছড়ির মন্দিরাছড়া ইত্যাদি পাহাড়ি গ্রামগুলিও উচ্ছেদ হতে বাধ্য হবে।
গত ৯ মার্চ ২০২৪ চাইচাল সেনা ক্যাম্পের সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল গাড়িযোগে গাছবাগান পাড়া গ্রামে উপস্থিত হয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া গ্রামবাসীদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে একটি সভা করে। এসময় সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের ১২ পরিবারকে অচিরেই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং তা না হলে আগামীতে খারাপ সময়ের সম্মুখীন হতে বলে হুমকি প্রদান করেন। এসময় সেনা সদস্যরা আরো জানিয়ে দেয় যে, তারা থুম পাড়া ও গাছবাগান পাড়ার মধ্যবর্তী পিলার চুগ ও লাঙেল টিলাতে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করবে, তাই সেখানে ও আশেপাশের এলাকায় জুম কাটা যাবে না এবং ইতোমধ্যে কাটা জুমগুলোতে আগুন দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এই দুই গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় জুমচাষ করা যাবে না।
এর পরদিনই (গত ১১ মার্চ) সেনাবাহিনী এক্সকেভেটর দিয়ে পিলার চুগ ও লাঙেল টিলায় মাটি কাটা শুরু করে এবং বুদ্ধলীলা চাকমার কাটা জুম ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। এর পূর্বে গত ৬ মার্চ সেনাবাহিনী বীরসেন তঞ্চঙ্গ্যার কাটা জুম এক্সকেভেটর দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
সর্বশেষ গত ১২ মার্চ ২৯২৪ চাইচাল সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন কবির ও সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) থুদো চাকমার বাড়িতে গিয়ে জুমের তালিকা চেয়েছেন। এসময় ক্যাপ্টেন কবির কার্বারি থুদো চাকমাকে বলেন, ‘তালিকা দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে, না দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কারো কখনও লাভ হয়নি। অতএব, সরকারের বিরুদ্ধে না গিয়ে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।’ এসময় ক্যাপ্টেন কবির রাতের মধ্যে জুমের তালিকা ক্যাম্পে গিয়ে জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে যান।
স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, গত ৮ মার্চ ২০২৪ বিকাল আনুমানিক ৩ টায় হেলিকপ্টার যোগে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সাইফুদ্দিন আহমেদ চাইচাল সেনা ক্যাম্পে সফর করেন। এর পরের দিনই (৯ মার্চ) চাইচাল ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা গ্রামে গিয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার জুম্ম গ্রামবাসীদের এই মর্মে জানিয়ে দেন যে, সেনা প্রধানের নির্দেশ জুমচাষ বন্ধ করতে হবে এবং গাছবাগান পাড়ার ১২ পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
স্মারকলিপিতে আরো বলা হয় যে, আমরা গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ায় বর্তমানে ২৩টি পাহাড়ি পরিবার বসবাস করে আসছি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরপরই ১৯৯৮ সাল থেকে এই জুম্ম পরিবারগুলো সেখানে বসতিস্থাপন শুরু করি। আমাদের প্রধান জীবিকা জুমচাষ। বিগত ২৪/২৫ বছরে তাদের অনেকেই কলাবাগান, আম-কাঠাল বাগান, ঝাড়–ফলের বাগান গড়ে তুলেছি। জুমে অনেকে ধানচাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, তিল, মরিচ ইত্যাদি চাষও করেছি।
সেনাবাহিনীর জুমচাষে নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে তারা অত্যন্ত দিশেহারা অবস্থায় পড়েছে। তাদের বাড়ি, ভূমি ও জীবিকা রক্ষায় গ্রামবাসীরা গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ প্রত্যাহার করা; গ্রাম সংলগ্ন পর্যটন স্থাপন না করা; জুম চাষে কোর বাধা প্রদান না করা এবং বাগান-বাগিচা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা- এই চারটি দাবি জানিয়েছে। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া এই গ্রামবাসীরা বর্তমানে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
সদয় অবগতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকেও অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে।