মিতুল চাকমা বিশাল
পাহাড়ে যে হারে উন্নয়নের ফিরিস্তি চলছে, যে হারে উন্নয়নের জয়গান চলছে এবং যে হারে উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে, সেটা উন্নয়নের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিকে এটি যেমন উন্নয়নের বিলাসিতা, অপরদিকে সেটিই আবার বিলাসিতার উন্নয়নও। আমাদের পাহাড়ে কত কিছুই হয়, রাস্তা হয়, সড়ক হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হয়, মেডিকেল কলেজ হয়, পর্যটন হয়, বাঁধ হয়, ভিউ পয়েন্ট হয়, সীমান্ত সড়কও হয়, আরো কত কি! বাহারি রঙের, বাহারি ধরনের, কত চাকচিক্যে, কত ঔজ্জ্বল্য, আহা! বিলাসিতা বলছি এই কারণে এত কিছুর ভিড়ে আমাদের পাহাড়ের সাধারণ জুম্ম জনগণের সামগ্রিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। উন্নয়নের এই যে বিলাসিতা তা পাহাড়কে আলোকিত করার বদলে অন্ধকারেই বেশি নিমজ্জিত করেছে।
এই যে দেখুন না, কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়েছে। সেখানে দেখা গেছে সাজেকের একজন দুঃখিনী পাহাড়ি মা পিঠে করে এক কাল্লোং-এ পানির বোতল নিয়ে আসছে সাজেক পর্যটনের প্রধান সড়ক ধরে। অথচ, রুইলুই পর্যটনের দোকানে রাখা সারি সারি বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার। পর্যটকদের সুবিধার জন্য রিসোর্টগুলোতে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন জল সরবরাহ ব্যবস্থা। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই আমাদের জন্য নয়। তার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রচলিত দৈনিক প্রথম আলোতেও একটি ছবি প্রকাশিত হয়, সেখানেও দেখা গিয়েছে পাহাড় বেয়ে কিছু পাহাড়ি নারী মাথায় ও পিঠে কলসি নিয়ে উপরে উঠছে। নিচে লেখা ছিল, ‘কয়েক মাস ধরে পাহাড়ে চলছে সুপেয় পানির সংকট। পানির জন্য পাড়ি দিতে হচ্ছে দুরের পথ’।
ঠিক একই সময়ে দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় ‘ছবিটি আমার মায়ের’-নামে একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে শাবিপ্রবি’র এক শিক্ষার্থী মিথুন চাকমা সাংবাদিক পিন্টু রঞ্জন অর্ককে জানিয়েছেন সাজেকের জুম্ম জনগণের দূর্ভোগের কথা। কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু পাহাড়ের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কোনো কিছুই করা হচ্ছে না। অথচ সেই টাকা দিয়ে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে চিকিৎসা সুবিধা ও বিদ্যুতায়ন করা যেত এবং একইসাথে তাদের জীবন মান ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেত।
সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র হওয়াতে সেই পর্যটনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সেখানে সড়ক নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রের বাইরে সাজেক পুরোটাই অন্ধকারে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, আপনার ভূমিকে দখল করে কেউ জবরদস্তি সেখানে পর্যটন বানালো, বিদ্যুৎ সংযোগ দিল, পুরো পর্যটন এলাকা আলোয় আলোকিত, কিন্তু আপনার ঘরে সেই আলো পৌঁছতে পারে না। রুইলুই এবং অন্যান্য অংশের সাথে অদৃশ্য এক দেওয়াল খাড়া করে রাখা হয়েছে সেখানে। সাজেকের রুইলুই এ পর্যটন কেন্দ্র বসানোর ফলে সেখানকার ৬৫টি লুসাই পরিবারকে দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী মিজোরামে যেতে হয়েছিল, সেটা আমাদের স্মরণেই হয়তো থাকে না। অনেকেই বলবে, তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে উচ্ছেদ করে তো পর্যটন হয়নি নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, তারা প্রত্যক্ষভাবে উচ্ছেদের শিকার হয়নি। কিন্তু তাদের জুমভূমি ও মৌজাভূমিকে দখল করে সেখানে পর্যটন করা হয়েছে। অপরদিকে পর্যটনের কারণে প্রতিনিয়ত পর্যটক আসা এবং সেখানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শব্দ দূষণ ও চিড়িয়াখানার জন্তুর মত স্থানীয়দের দেখতে পর্যটকদের হুড়োহুড়ি, তাদেরকে দেশান্তরী হতে আরো দ্রুতবেগ দিয়েছে। বর্তমানে সাজেকের সেই পর্যটন কেন্দ্রে ‘লুসাই বিহীন লুসাই সংস্কৃতি’ প্রদর্শন করানো হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লুসাই হ্যারিটেজ ভিলেজ’। লুসাইদের পরিধেয় বস্ত্র পরে সেখানে বহিরাগত বাঙালিরা লুসাই সেজে বসে থাকে। এ যেন ‘পাহাড়ি বিহীন পাহাড়ি সংস্কৃতি’ চালু হওয়ার আগমনী বার্তা। একইসাথে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে ‘দারুস সালাম জামে মসজিদ’, কিন্তু সেখানে বসবাস ত্রিপুরা ও পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর। অথচ ঠিক তার পাশেই আছে সাজেক ‘বিজিবি ক্যাম্প মসজিদ’। চিন্তা করে দেখুন তো! পাহাড়ি অধ্যুষিত সেই অঞ্চলে এখন প্রতিনিয়ত আযানের ধ্বনি উৎসারিত হয়। পর্যটকদের জন্যে যদি মসজিদ নির্মাণ করা যায়, তাহলে মন্দির-গীর্জা-বিহার নির্মাণ করা হয়নি কেন? সাজেকে পর্যটক হিসেবে কি শুধু মুসলিমরাই যায়?
তাহলে এর থেকে আমরা দু’টি জিনিস সম্পর্কে ধারণা পায়। প্রথমত, পাহাড়ে পর্যটন হলেও সেই পর্যটন আমাদের জন্য নয়। কেননা পর্যটনের রিসোর্ট ব্যবসা সেনাবাহিনী ও বহিরাগত বড় বড় পুঁজিপতি/আমলাদের হাতে। একইভাবে পাহাড়ে উন্নয়ন হলেও সেই উন্নয়ন সুষম উন্নয়ন নয় এবং তা আমাদের জন্যেও নয়। কারণ সুষম উন্নয়নের প্রধান শর্ত স্থানীয়দের সম্পৃক্তকরণ ও সংশ্লিষ্টকরণ। দ্বিতীয়ত, এই তথাকথিত উন্নয়ন এবং পর্যটনের ফলেই আমাদের Socio-economy-তে বিরাট প্রভাব পড়েছে। কেননা, পাহাড় কেটে, বনভূমি ধ্বংস করে, ঝিড়িতে বাঁধ দিয়ে সড়ক নির্মাণ এবং পর্যটন কেন্দ্রে পানির সরবরাহ ব্যবস্থার জন্যে ঝিড়িতে বাঁধ দিয়ে জলের স্বাভাবিক প্রবাহ রোধ করে এবং বাঁধের ভাটিতে জলের পরিমাণ থাকায় তা পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য তথা পাহাড়ের Ecosystem-কে বিরাট হুমকিতে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ আরো হ্রাস পাচ্ছে, যার ফল গত কয়েক বছরের মধ্যে থানচি ও সাজেকে খাদ্যসংকট এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পাহাড়ে পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। এরই ফলে পাহাড়িরা নিজেদের বসতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে এবং প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিকতায় তারা চলে যাচ্ছে। যার দরুণ তাদের স্থায়ীত্ব ধারণের জায়গাতে বিরাট প্রভাব পড়ছে, যা তাদেরকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে অন্তরায় রূপে দেখা দিয়েছে। একইসাথে পরিত্যক্ত ভূমিগুলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা প্রতিষ্ঠান দিয়ে দখলে নেওয়ার উন্মত্ত প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আরো যদি বিশদভাবে বলতে গেলে, তথাকথিত এই উন্নয়ন যাদের জন্য করা হচ্ছে বলে জোর প্রচারণা চলছে, বাস্তব ক্ষেত্রে তাদেরকে একেবারে উহ্য রাখা হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কোনপ্রকার সংশ্লিষ্টতা, অংশগ্রহণ ও মতামত ব্যতিরেকে এবং তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনপ্রকার বাছ-বিচার না করে সম্পূর্ণ একপাক্ষিকভাবে এই কাজগুলো চলমান রয়েছে। একইসাথে সাধারণ জুম্ম জনগণ যাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে বা নতুন পরিস্থিতিতে যাতে করে পাহাড়িরা টিকে থাকতে পারে, সেধরনের কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগও সরকারিভাবে কিংবা বেসরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার সেটাই হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, এতে করে পাহাড়িদের দারিদ্র্যতার হার বছরের পর বছরে বেড়েই চলেছে। অতি সম্প্রতি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ‘পার্টনারশিপ ফর রেজিলিয়েন্ট লাইভলিহুডস ইন সিইএইচটি রিজিয়ন (পিআরএলসি)’-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, সমতলের চেয়ে তিন পার্বত্য জেলার জনগোষ্ঠী জীবনমানের দিক থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে। জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিপরীতে পার্বত্যাঞ্চলে সেই হার ৪৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে। এ জেলায় হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং রাঙামাটিতে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, উন্নয়নটা কার স্বার্থে?
সত্যি বলতে, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সড়কের পর সড়ক বানিয়ে পাহাড়কে লুন্ঠনের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ ও খনিজ সম্পদকে অতি সহজে লুন্ঠনের অন্যতম উপায় এই সড়ক উন্নয়ন। এটা অনেকটা ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশকে লুন্ঠনের মতন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পদ দিয়ে পাহাড়ের বাইরের সমতল জেলাগুলো ঝিকঝিক করছে, পাহাড়ের ঝিরি থেকে উত্তোলিত পাথর দিয়ে আজ দেশের মহাসড়ক আর রেললাইন হচ্ছে, পাহাড়কে ডুবিয়ে সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে পাহাড়ের বাইরে কলকারখানা চলছে, বন্দর চলছে, অথচ পাহাড়কে রাখা হয়েছে শেকল পড়িয়ে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। যার নামই দেওয়া হচ্ছে ‘উন্নয়ন’?