হিল ভয়েস, ২১ মার্চ ২০২৪, রাঙ্গামাটি: আজ ২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে রাঙ্গামাটি জেলাধীন জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী গাছবাগান পাড়া ও থুমপাড়া নামে দুটি গ্রাম উচ্ছেদ বন্ধের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের ছাত্র-যুব সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ঢাকার শাহবাগে একটি বিক্ষোভ মিছিল ও তার পরবর্তী প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল চাকমার সঞ্চালনায় এবং বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর সভাপতি তৌহিদুর রহমান তৌহিদ এর সভাপতিত্বে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নানু, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরান, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র সভাপতি অতুলন দাস আলো, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) এর সভাপতি গৌতম শীল, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা ও বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি দনওয়াই ম্রো প্রমুখ।
উক্ত সমাবেশে বিবৃতি পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি দনওয়াই ম্রো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়ন-নির্যাতন করে আসছে দেশের শাসকগোষ্ঠী। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক জেলা পরিষদের প্রকল্পগুলোতে পাহাড়িদের ভালোভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসীদের জীবনমানের উপর সবসময় আঘাত হানা হয়। উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের উপর রোলার কোস্টার চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা বলেন, সীমান্ত সড়কের পাশে পর্যটনের নামে দুটি পাহাড়ি গ্রামকে উচ্ছেদ করার জন্য সেনাবাহিনী পাঁয়তারা চালাচ্ছে। পাহাড়ের মানুষের প্রধান জীবিকা জুম চাষ। এখন জুম চাষ, হলুদ চাষ, আদা চাষ যদি করতে না দেয় এই দেশের শাসকগোষ্ঠী তাহলে আদিবাসীদের জীবনমান কেমন হবে তা আপনারা ভাবুন। আমরা কেউ উন্নয়নের বিরোধী নই, পর্যটনের বিরোধী নই। কিন্তু পর্যটনের নামে যদি আমাদের উচ্ছেদ করা হয়, আমরা সেই উন্নয়নের বিরোধী। পাহাড় থেকে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করতে হবে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি ব্যবস্থাপনা জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হোক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা বলেন, পাহাড়-সমতলে ঘটনা নিয়ে আমাদের বারে বারে এই শাহবাগে দাঁড়াতে হয়। যেটি খুবই দুঃখজনক। পাহাড়িদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে উন্নয়ন করাকে আমরা উন্নয়ন হিসেবে দেখি না। ভুক্তভোগী পাহাড়িদের গ্রেপ্তার করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক হয়ে যদি তারা ভক্ষক হয় তাহলে হবে না। তারা কেন পর্যটনের ব্যবসা করবে? তারা পাহাড়িদের বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বানচাল করার জন্য শাসকগোষ্ঠী নানারকম ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রগতিশীল সকল ছাত্র সমাজকে লড়াই-সংগ্রামে থাকার জন্য আহ্বান জানান।
জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি গৌতম শীল বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী হাজার বছর ধরে জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। আর তা বন্ধ করার জন্য অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন তার সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে সমান চোখে দেখে না তা খুবই লজ্জাজনক। দুঃখ হলেও সত্যি যে, আজকে সেনাবাহিনী উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। উন্নয়নের নামে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা বন্ধ করুন।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন বলেন, যেকোনো উন্নয়ন সেটা জনবান্ধব হতে হবে। সাজেকের লুসাইদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া করা হয়েছিল। একধরনের ব্যবসায়িক গোষ্ঠী লুট করে যাচ্ছে আর সরকার তা করার জন্য সহযোগিতা প্রদান করবে তা আমরা হতে দিব না।
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি অতুলন দাস আলো সমাবেশের সাথে সংহতি জ্ঞাপন করে বলেন, সমতলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা সরকার করে। কিন্তু পাহাড়ের বিষয়টা অন্যরকম। যেমন খুশি তেমন সাজো একটা অবস্থা। কিন্তু পাহাড়ে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া তো হয় না। উল্টো রাতের বেলা বিশেষ বাহিনীকে পাঠিয়ে পাহাড়িদের গুম করে দেওয়া হয়। একটি রাষ্ট্রে দুইটি নীতি হতে পারে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে বাঙালির রক্তের পাশাপাশি পাহাড়িদেরও রক্ত আছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে এইসকল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন সুপেয় পানির ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো মানের শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। মৌসুমি পর্যটকদের ছুড়ে দেওয়া একটি চকলেটের পিছনে পাহাড়ি শিশুদের ছুটে চলা এই ব্যবস্থা আমরা হতে দিব না।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বলতে চাই আমরা জাতীয় জাদুঘরের বাক্সে শুধু থাকতে চাই না। আমরা ভূমি অধিকার সহ সকল ধরনের অধিকার চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলারদের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হয় নাই। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ইন্ধনে আজ পাহাড়ে ধর্ষণ, নিপীড়ন, গুম চলমান রাখা হয়েছে। তা যদি বন্ধ না হয় পাহাড়-সমতলের রাজপথে আমরা সংগ্রাম জারি রাখব।
সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নানু বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সমান নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়নি। পার্বত্য চুক্তি ২৬ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ে ভূমি বেদখল বন্ধ হয় নাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর হয় নাই। সরকার একটি বাহিনীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পাহাড়ের সমস্যাকে সমাধান করছে না। সীমান্ত সড়ক বানানোর জন্য কেন গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ করা হবে। এইভাবে উচ্ছেদ করতে থাকলে পাহাড়িরা কোথায় যাবে? যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি জমিও খালি রাখা যাবে না। তাহলে আজ কেন পাহাড়িদের জুমচাষ না করার জন্য বলা হচ্ছে?
সভাপতির বক্তব্যে তৌহিদুর রহমান তৌহিদ বলেন, পাহাড়িদের উচ্ছেদ করার যে অভিযান চালানো হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের আদিবাসীদেরকে সমান অধিকার দিতে হবে। কাপ্তাই বাঁধের মাধ্যমে পাহাড়িদের উদ্বাস্তু করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে সেসকল উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসনের কথা বলা হলেও দিনশেষে পার্বত্য চুক্তি এখনও বাস্তবায়ন করা হয় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হলেও কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় না। তিনি আরও বলেন, পর্যটন প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের রাখতে হবে। ইকো ট্যুরিজম নিশ্চিত করতে হবে। যে দুটি গ্রামকে উচ্ছেদ করে পর্যটন করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে তা বন্ধ করে গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।
সমাবেশ থেকে নিম্নোক্ত ৮দফা দাবি জানানো হয়-
১। পর্যটনের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ বন্ধ করা।
২। পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল বন্ধ করা।
৩। গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা বিধান করা।
৪। গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ প্রত্যাহার করা।
৫। গ্রাম সংলগ্ন পর্যটন স্থাপন না করা।
৬। জুম চাষে কোনো বাধা প্রদান না করা।
৭। সীমান্ত সড়ক প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।
৮। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক অবিলম্বে জেলা পরিষদের নিকট পর্যটন খাতকে হস্তান্তর করা।