হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সমাজে নারীর মানবাধিকার তথা সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সকল ক্ষেত্রে নারীর উপর চলমান বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামসহ সামগ্রিকভাবে সমাজ প্রগতির আন্দোলনে ৮ মার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। প্রতি বছর এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নারীরা একযোগে বিশ্বব্যাপী তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া সকল প্রকার পারিবারিক, সামাজিক, লিঙ্গগত, জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও সহিংসতাকে তুলে ধরার প্রয়াস পান। পাশাপাশি এসমস্ত শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং সকল প্রকার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত হন।
জানা যায়, প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালিত হয় ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দলের উদ্যোগে। আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দল এই দিনটিকে চিহ্নিত করে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সম্মানে, যেখানে নারীরা কাজের অমানবিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক মজুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্বের সংগ্রামী ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী ক্লারা জেটকিন সহ কয়েকজন নেত্রী একটি বার্ষিক নারী দিবস প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। যদিও সেই সময় কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি। এর পরবর্তী বছর, ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ তারিখে ডেনমার্ক, জার্মানি সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এসময় ইউরোপের দেশে দেশে নারীরা তাদের ভোটাধিকার সহ বিভিন্ন দাবিতে এবং চাকরিতে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বস্তুত ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারে এর পরপরই কখনো ১৯ মার্চ, কখনো ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার, ১৫ এপ্রিল কিংবা ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ শনিবারে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে যা ৮ মার্চ) রাশিয়ার নারীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে ধর্মঘট করে। অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় এই দিনটি (৮ মার্চ) একটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে এই ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী হিসেবে পালিত হতে থাকে।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘও এই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী হিসেবে উদযাপন করতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ অধিবেশনে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতিসংঘ এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে- ”INVEST IN WOMEN: ACCELERATE PROGRESS”, যাতে মূলত সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রগতিকে ত্বরান্বিত ও গতিশীলকরণে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে বিনিয়োগ ও বিশেষ মনোযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, বিশ্বের নারী সমাজের জাগরণের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন, পারিবারিক দাসত্ব ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জুম্ম নারী সমাজকে লড়াইয়ে সংগঠিত করতে ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি এবং শুরু জুম্ম নারী মুক্তি আন্দোলন। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালে শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত জাতিগত নিপীড়ন, নির্যাতন, বঞ্চনা ও জুম্ম নারীর উপর সহিংসতার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্রীদের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ গঠন করা ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’। গঠনের পর থেকেই এই দুই সংগঠন জুম্মদের উপর জাতিগত নিপীড়ন ও আগ্রাসনের পাশাপাশি স্বীয় সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে নারী সমাজকে জাগরিত ও সংগঠিত করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরও সংগঠন দুটি পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক উভয় ক্ষেত্রের আন্দোলনে জুম্ম নারী সমাজের রয়েছে অপিরসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অসাধারণ অবদান।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা বৈষম্য সত্ত্বেও জুম্ম নারীরা আজ কী রাজনীতিতে, কী প্রশাসনে, কী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, ক্রীড়াঙ্গণে, শিল্পকলায়, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নানাভাবে তাদের অভাবনীয় যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু তবুও জুম্ম নারীরা প্রতিনিয়ত জাতিগত সহিংসতা ও নিপীড়ন এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। যা দেশ, সমাজ ও পারিবারিক উন্নয়নে ও প্রগতিতে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। পুরষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারের জাতিগত নিপীড়ন ও আগ্রাসনে জুম্ম নারীরা যেমন সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছেন, তেমনি স্বীয় সমাজেও জুম্ম নারীরা পুরুষতন্ত্রের নানা আধিপত্য, দমন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
এটা আজ সর্বজনবিদিত যে, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীকে বঞ্চিত ও নিপীড়নের মধ্যে রেখে কোনোভাবেই একটি রাষ্ট্র, সমাজ, জাতি ও পরিবার সুষমভাবে এগিয়ে যেতে পারে না এবং তার পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন, ‘পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে, নারীকেও সেই অধিকার দিতে হবে।’ অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিক কালে জুম্ম নারী সমাজের অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও এখনও সার্বিকভাবে তারা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে যেমনি মুক্ত নয়, তেমনি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবহেলার কারণে তারা তীব্রভাবে জাতিগত নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১৩৫টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৬৪৩ জন জুম্ম মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৩১ জনকে গ্রেফতার ও সাময়িক আটক, ২৪৫ জনকে মারধর, আহত ও হয়রানি, মিথ্যা মামলার শিকার ৫৩ জন, ৬৪টি গ্রামে সামরিক অভিযান পরিচালনা, ৮৪টি বাড়ি ও পরিবারকে সেনা তল্লাসী, ৩১ পরিবারকে উচ্ছেদ ও উচ্ছেদের হুমকি, ৫টি নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। একই সময়ে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক সংঘটিত ২৪টি ঘটনায় ১৯টি পরিবার ও ২১০ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।
অপরদিকে, ২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ২৪টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ২৫ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে একজনকে হত্যা, ১২ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ, ৭ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং ২ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ ও পাচারের চেষ্টার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ও প্রচারিত এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ‘বস্তুত এ যাবত জুম্ম নারী ও শিশুর ওপর যত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার কোনটিরই দৃষ্টান্তমূলক সুষ্ঠু বিচার হয়নি। বিশেষ করে এই বিচারহীনতা এবং পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে অপরাধীরা পার পাওয়ায় বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। ফলে জুম্ম নারীরা এখনো চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে।
সর্বোপরি পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি দীর্ঘ ২৬ বছরেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া, উপরন্তু শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর ও বিস্ফোরন্মুখ। চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ের মতই বর্তমানেও জুম্মদের উপর একপ্রকার অবাধে চলছে আগ্রাসন, ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, সামরিক দমন-পীড়ন-অভিযান, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা ও জেল-জুলুম, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, অনুপ্রবেশ, জুম্মদের সংখ্যালঘুকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী ও জুম্মদের জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের প্রক্রিয়া।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এহেন অনিশ্চিত ও নাজুক পরিস্থিতিতে জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা যেমনি প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হয়ে চলেছে, তেমনি তারা অত্যন্ত নিরাপত্তাহীন জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। সর্বোপরি জুম্ম নারীর জাতীয় অস্তিত্ব আজ চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।’
সংগঠন দুটি আরও বলেছে, ‘জুম্ম নারীর নিরাপত্তা, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিতকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতির উপর জাতিগত নিপীড়ন ও সহিংসতা, জুম্ম নারীর মুক্তি ও নিরাপত্তা, সর্বোপরি সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।’
জুম্ম নারীদের লড়াকু দুই সংগঠন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জুম্ম নারী সহ দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলসমূহকে চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে অধিকতর সামিল হওয়া আহ্বান জানিয়েছে।