হিল ভয়েস, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রাঙ্গামাটি: আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রোজ শুক্রবার রাঙ্গামাটির সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), রাঙ্গামাটি জেলা শাখার ২৫তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
“সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন“ স্লোগানে সম্মেলনে পিসিপি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমার সভাপতিত্বে উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুবিনা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটির জেলা শাখার সভাপতি ম্রানুচিং মারমা।
সম্মেলনের শুরুতে পিসিপি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক টিকেল চাকমার সঞ্চালনায় এযাবৎ কালে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মবলিদানকারী সকল বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুমন চাকমা।
হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ম্রানুচিং মারমা বলেন, অধিকারহারা জুম্মরা অধিকার না পেয়ে অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ভয়ে জুম্ম নারীরা অনিরাপদ জীবন কাটাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাই, অস্তিত্ব রক্ষায় দোদুল্যমানতা কাটিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বলেন, ১৯৬৪ সালে মুক্তিকামী পাহাড়ী ছাত্ররা “পাহাড়ি ছাত্র সমিতি” নামে এক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলে। পাকিস্তান সরকারের জুম্ম বিধ্বংসী কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ গড়ে তোলে। তাদের স্লোগান ছিল শিক্ষা গ্রহণ করো, গ্রামে ফিরে চলো। তারা শিক্ষা গ্রহণের পর পশ্চাদপদ জুম্ম সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েন, পাহাড়ি সমাজের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করেন।
তিনি সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করে দিয়ে বলেন, বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত ছাত্র সমাজকে ঠিক সেভাবে আরো একবার এগিয়ে আসতে হবে। পিসিপি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে ছাত্র সমাজকে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। শিক্ষিত পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে সেই আহ্বানকে বুঝতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নে পিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে দিকে দিকে ভয়-আতঙ্ক, ত্রাস বিরাজমান। ভয় ও হতাশায় নিমজ্জিত ছাত্র সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ছাত্র সমাজের উপর নির্ভর করবে জুম্ম জনগণের আগামী ভবিষ্যৎ। তাই ঘুমন্ত ছাত্র সমাজকে জাগাতে পিসিপিকে গুরু দায়িত্ব নিতে হবে।
যুব সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সরকার এই চুক্তিকে বাস্তবায়ন না করে মিথ্যাচার চালাচ্ছে। জুম্ম জনগণ যাতে চুক্তিকে ভুলে যায় সেই লক্ষ্যে সরকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে হতাশায় নিমজ্জিত না থেকে সংগঠিত হতে হবে।
মহিলা সমিতি সভানেত্রী সুবিনা চাকমা বলেন, স্মরণাতীত কাল থেকে জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। তারা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে পারে না। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ছাত্র সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ছাত্র অবস্থা থেকেই এম এন লারমা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন। ১৯৬০ সালে এম এন লারমা মরণফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এমএন লারমা বলেছিলেন- আমরা সংখ্যায় কম, তাই সংগঠন করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এম এন লারমার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দূরদর্শিতা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমামের ষড়যন্ত্রের কারণে জুম্মরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনাই। দেশের অধিকাংশ মানুষ এ বৈষম্যের কথা জানে না। তবুও, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জুম্ম জনগণ হৃদয়ে ধারণ করে রাখে। দেশের কাজে অনেক জুম্ম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, অযথা সময় নষ্ট না করে পড়ালেখা করতে। জ্ঞান অর্জন করে সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। সত্যিকার জ্ঞান অর্জন করে সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে হবে। শিক্ষিত হওয়া মানে নিজের শিকড়কে ভুলে যাওয়া নয়। নিজের সংস্কৃতি আমাদের আসল পরিচয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মাথা উচু করে বেঁচে থাকার সাহস অর্জন করতে হবে। দীর্ঘ ২৪ বছর সশস্ত্র লড়াই করে সরকারকে বাধ্য করেছি চুক্তি করতে। ঐক্যবদ্ধ জাতি বলে আমরা দেখিয়েছি অধিকার আদায়ে লড়াই করতে পারি। সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করছে। অন্যদিকে চুক্তি বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবানে সরই ইউনিয়েন ম্রোদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ম্রোরা যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে সেই ঝিড়িতেও ভূমিদস্যুরা বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। অথচ প্রশাসন নিশ্চুপ ভূমিকায় রয়েছে। ম্রোরা তারপরও নিজ বাস্তুভিটা রক্ষায় লড়াই করে টিকে আছে।
তিনি আরো বলেন, সংগ্রাম ছাড়া অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। এম এন লারমারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুণেধরা জুম্ম সমাজকে রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত করেছে। শিক্ষার কোনো শেষ নেই। ভুল চিন্তাধারা পাশ কাটিয়ে ভালো কাজে মনোযোগী হতে হবে। মতাদর্শগত সংগ্রামের মাধ্যমে কর্মীদের এগিয়ে যেতে হবে। আর্থসামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সংগ্রামের রূপরেখা নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে।
বিশ্বরাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। আমাদের জীবন সংগ্রামমুখর। যোগ্য হতে হবে, ত্যাগের মানসিকতা থাকতে হবে। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে আমাদের অনেক বসন্ত পার হয়ে গেছে। তারপরও চুক্তি বাস্তবায়নে আমাদের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়ে যার যার কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
দ্বিতীয় পর্বের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক উ উইন মং জলি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সহ সম্পাদক জুয়েল চাকমা ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক থোয়াইক্যজাই চাক। এতে রাঙ্গামাটি জেলা শাখার বিভিন্ন থানা ও কলেজ কমিটির প্রতিনিধিরা সাংগঠনিক বক্তব্য তুলে ধরেন।
সম্মেলন শেষে জিকো চাকমাকে সভাপতি , টিকেল চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সুমন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২৭ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপি, রাঙ্গামাটি জেলা শাখার ২৫তম কমিটি গঠিত হয়। নবগঠিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান পিসিপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা।
পরবর্তীতে পিসিপি রাঙ্গাসাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমার সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ২৫তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল সমাপ্তি ঘটে।