হিল ভয়েস, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়িতে সেনাবাহিনীর মদদে কতিপয় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক এক জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি বেদখলের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারী ৫ জুম্মকে সেনাবাহিনী স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করে। গণমাধ্যমে প্রচার ও বিভিন্ন চাপে পরে ঐদিনই রাতে সেনাবাহিনী ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও এখনো পর্যন্ত ভুক্তভোগী ওই ৫ ব্যক্তিকে জুরাছড়ি সদরস্থ পার্বত্য জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে বাধ্য করছে বলে জানা গেছে। এমনকি মারধরের কারণে ব্যাপক জখম হওয়ায় ভুক্তভোগীরা স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইলে এবং চিকিৎসার জন্য রাঙ্গামাটি শহরে যেতে চাইলেও সেনাবাহিনী অনুমতি দিচ্ছে না এবং বাধা দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী একদিকে উল্টো মারধরের শিকার হওয়া জুম্মদের কিছুদিন আগে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্ত কর্তৃক এক শিক্ষিকার স্কুটি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার সাথে যেমন জড়িত করার চেষ্টা করছে, অপরদিকে ভুক্তভোগীরা যেহেতু আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের কর্মী, তাই চিকিৎসার জন্য রাঙ্গামাটি গেলে পথে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা গুলি করবে এমন ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে।
ভুক্তভোগী ৫ জুম্ম হলেন- (১) পল্লব দেওয়ান (৪৮), পিতা-অমৃত লাল দেওয়ান, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, জুরাছড়ি থানা আওয়ামী লীগ ও ১নং জুরাছড়ি ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার; (২) সজীব চাকমা (৩২), পিতা-বিপ্লব চাকমা, গ্রাম-বরইতুলি, ৩নং ওয়ার্ড, ২নং বনযোগীছড়া ইউনিয়ন এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক, জুরাছড়ি থানা যুবলীগ; (৩) অনুপম চাকমা (৫৫), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-ধামাই পাড়া, তিনি ২নং বনযোগী ছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি; (৪) মিন্টু চাকমা (৩২), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-কুসুমছড়ি, ৯নং ওয়ার্ড, ১নং জুরাছড়ি ইউনিয়ন, তিনি ১নং জুরাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও (৫) রন্টু চাকমা (৩৮), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-বরইতুলি, তিনি জুরাছড়ি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
উল্লেখ্য যে, গত ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ বনযোগীছড়া সেনা জোনের অধীন যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশাররফ এর নেতৃত্বে ১৫-২০ জন সেনা সদস্য সেটেলার বাঙলি কর্তৃক ভূমি বেদখলে বাধাদানকারী জুম্মদের মধ্য থেকে ৬ জনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে আওয়ামীলীগের সাথে যুক্ত উক্ত ৫ জন এবং আরেকজন নিরীহ গ্রামবাসী। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া ৬ জনের মধ্যে গ্রামবাসী একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, অপরদিকে উক্ত ৫ জনকে ব্যাপক মারধর করে সেনা সদস্যরা।
জানা গেছে, যক্ষাবাজার ক্যাম্পের সেনাবাহিনী মারধরের সময় উক্ত ৫ জনকে ইতোপূর্বে দুর্বৃত্ত কর্তৃক এক স্কুল শিক্ষিকার স্কুটি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার সাথে তারা জড়িত বলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। উল্লেখ্য, মাসখানেক আগে রাতে শিউলী চাকমা নামে এক শিক্ষিকার স্কুটিটি আগুনে পুড়ে দেয় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা।
জানা গেছে, স্বীকারোক্তিতে সেনাবাহিনী নিজেরাই এই বানোয়াট যুক্তি বা ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করে যে, বিগত ৭ জানুয়ারি ২০২৪ জাতীয় নির্বাচনের সময় ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষিকা শিউলী চাকমা উক্ত ৫ জনকে জালভোট দিতে বাধা প্রদান করে, সেই ক্ষোভ থেকেই তারা স্কুটিটি পুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, শিউলী চাকমার সেদিন কোনো ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব ছিল না। বস্তুত অন্যায়ভাবে উক্ত ৫ জনকে মারধরের ঘটনাকে জায়েজ ও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং শিক্ষিকার সাথে ভুক্তভোগী ৫ জনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির করার উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনী এই ধরনের একটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা চালায়।
ভুক্তভোগীর সূত্র জানায়, নানা চাপে পরে সেনাবাহিনী রাত ৯টার দিকে আটককৃত ও মারধরের শিকার ৫ জনকে ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়। এসময় ক্যাম্পের সেনাবাহিনীর একটি দল নিজেরা এসে ওই ৫ জনকে উপজেলাস্থ পার্বত্য জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজে পৌঁছিয়ে দিয়ে যায়। এসময় সেনা সদস্যরা ওই ৫ জনকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে যায় যে, তারা যেন সেই জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজের বাইরে কোথাও না যায়। বস্তুত সেনাবাহিনী ক্যাম্প থেকে ওই পাঁচ জনকে ছেড়ে দিলেও রেস্ট হাউজে বন্দি করে রাখে।
ঘটনার পরদিন (১৪ জানুয়ারি) সকালে বনযোগীছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তোষ চাকমার সহযোগিতা নিয়ে ওই ৫ জন চিকিৎসার জন্য রাঙ্গামাটি শহরে যাবেন এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং একটি স্পিড বোটও ভাড়া করা হয়। বিষয়টি খবর পেলে বনযোগীছড়া সেনা জোনের সেনাবাহিনী ঐ স্পীড বোটের চালককে রাঙ্গামাটি বা কোথাও যেতে পারবে না বলে নির্দেশ দেয়।
একই দিন পরে, যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের একদল সেনাসদস্য ঝুড়িতে কিছু ফল, যেমন আপেল, আঙুর নিয়ে রেস্ট হাউজে ভুক্তভোগী ৫ জনকে দেখতে আসে। ফল ও কিছু ঔষধপত্র দিয়ে সেনা সদস্যরা আবার চলে যায়। এই সময় আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা ভুক্তভোগীদের জুরাছড়ি উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলেও সেনাবাহিনী অনুমতি দেয়নি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।
জানা গেছে, মারধরের শিকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জখম হয়েছে আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সজীব চাকমা ও আওয়ামীলীগের ১নং জুরাছড়ি ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক মিন্টু চাকমা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভুক্তভোগীরা এখনো চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি। অপরদিকে রাঙ্গামাটিতে যেতে পারছে না সেনাবাহিনীর বাধার কারণে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে পরিচালিত তদন্তে দেখা যায় যে, ভোটের দিন শিক্ষিকা শিউলি চাকমা কোনো কেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন না। সুতরাং ঐদিন ভোটদান নিয়ে শিউলী চাকমার সাথে মারধরের শিকার ৫ ব্যক্তির কোনো দ্বন্দ্ব এবং তা নিয়ে পরস্পরের প্রতি কোনো ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ৫ ব্যক্তি কর্তৃক শিউলী চাকমার গাড়ি পোড়ানোর সেনাবাহিনীর ব্যাখ্যাও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। বস্তুত সেনাবাহিনী তাদের দ্বারা জুম্মদের ভূমি বেদখলে উস্কানি ও প্রতিবাদী ৫ জুম্মকে অন্যায়ভাবে মারধরের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই উক্ত মিথ্যা ও বানোয়াট ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে বলে জানা যায়।
একটি গোপন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, রাঙ্গামাটিতে বিশেষত জুরাছড়িতে বিগত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সেনাবাহিনী ও আওয়ামীলীগের মধ্যে একটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনীর ধারণা, নির্বাচন নিয়ে আওয়ামীলীগ ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটা গোপন সমঝোতা হয়েছে, তাই জনসংহতি সমিতি তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছে। একারণে জুরাছড়ির সেনাবাহিনী আওয়ামীলীগের উপর ক্ষুব্ধ।
এদিকে গোয়েন্দা ও ভুক্তভোগীদের সূত্রে আরো জানা যায়, সেনা ক্যাম্পে ৫ জুম্মকে যখন মারধর করা হচ্ছিল, তখন সেখানে ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশাররফ সকলের সামনে এও বলেন যে, ‘প্রবর্তক চাকমা ও জ্ঞানেন্দু চাকমাকেও ফোন করে খবর দাও। তাদেরকেও আমরা মারধর করি। তারা কিসের আওয়ামীলীগ করে! কিসের ক্ষমতা দেখায় এখানে!’ ঐ ঘটনার পর এখনো পর্যন্ত প্রবর্তক চাকমা ও জ্ঞানেন্দু চাকমা জুরাছড়ি যাননি বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, প্রবর্তক চাকমা জুরাছড়ির আওয়ামীলীগ নেতা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য এবং জ্ঞানেন্দু চাকমাও জুরাছড়ি আওয়ামীলীগের একজন নেতা ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য।
সূত্রগুলো আরও জানায়, মারধরের শিকার ৫ জনকে রাঙ্গামাটি যেতে বাধা দানের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী এই মিথ্যা ও বানোয়াট অজুহাত দেখিয়েছে যে, তারা নাকি খবর পেয়েছে, জনসংহতি সমিতির জুরাছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমিত চাকমা রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে চিলেকধাক এলাকায় ১৫ জন লোক নিয়োগ করেছে। ওই লোকরা ভুক্তভোগী ৫ জুম্মকে গুলি করার জন্য অপেক্ষা করছে। কাজেই ওই ৫ জনের নিরাপত্তার স্বার্থেই সেনাবাহিনী তাদেরকে রাঙ্গামাটি যেতে বাধা দিয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত পিএসসি, মেজর আউয়াল ও যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশাররফ এর বিভিন্ন সময়ের ভাঙনমূলক ও এলাকার জনগণের স্বার্থ বিরোধী ভূমিকার কারণে জুরাছড়ির বিভিন্ন স্তরের জনগণ তাদের ব্যাপারে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। জনগণের বিশ্বাস, এইসব সেনা কর্মকর্তাদের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে জুরাছড়িতে সেনাবাহিনীর উপর্যুপরি হয়রানিমূলক সেনা টহল, বাড়ি তল্লাসি, জনগণকে মারধর, জুম্মদের ভূমি বেদখল করে তৎস্থলে বহিরাগত সেটেলার বসতিদানের ষড়যন্ত্র, ভাগ করো ও শাসন করো কৌশল অবলম্বন করে জনগণকে হয়রানি ও নিপীড়নকরণ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানা গেছে, জনগণের পক্ষ থেকে নানাভাবে উক্ত সেনা কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলি করানোর জন্য চেষ্টার কথা শুনলে জোন কমান্ডার কর্তৃক এই মর্মে মন্তব্য করতে শোনা গেছে যে, ‘যেখানেই বদলি হয়ে যাই না কেন সিও হিসেবেই থাকবো, কিন্তু বদলি হয়ে যাওয়ার আগে একটা কিছু করে যাবো।’ জনগণের অনেকেই জোন কমান্ডারের এই কথাকে হুমকি মনে করছেন এবং তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, গত ১৩ জানুয়ারি, সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে ৫ জন বহিরাগত মুসলিম সেটেলার বাঙালি জুরাছড়ি সদরে অবস্থিত হিমায়ন চাকমার পৈত্রিক সম্পত্তি ০.২০ একর পরিমাণ জায়গাটি বেদখলের উদ্দেশ্যে জায়গাটির চারিদিকে খুঁটি পুঁতে দেয়। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর জায়গার মালিক সহ জুম্ম এলাকাবাসী সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
বেদখলের চেষ্টাকারী সেটেলাররা হল- (১) মোঃ সিরাজ (৩২), পিতা-অজ্ঞাত, পেশায় দিনমজুর ও খুচরা তৈল ব্যবসায়ী; (২) মোঃ সোহেল (৩০), পিতা-অজ্ঞাত, পেশায় করাট কল মিস্ত্রি; (৩) মিঠুন (২৭), চায়ের দোকানদার; (৪) মোঃ ফয়সাল (২৯), পিতা-অজ্ঞাত, পেশায় কাপড় দোকানদার ও (৫) নাম জানা যায়নি।
পরে নিকটবর্তী যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশাররফ এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে এসে ৬ জুম্মকে ধরে নিয়ে যায়। আরও কিছক্ষণ পর বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার লে: কর্নেল জুলকিফলী আরমান বিখ্যাত পিএসসি ঘটনাস্থলে আসেন এবং সেখান থেকে যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পে যান।