হিল ভয়েস, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, চট্টগ্রাম: গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ(পিসিপি), চট্টগ্রাম মহানগর শাখা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ৩০তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়। “দেশের সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% আদিবাসী কোটা চালু কর” দাবি এবং “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে ছাত্র ও যুব সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হউন” এই স্লোগানকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ও কাউন্সিলটি চট্টগ্রাম নগরস্থ হালদা মিলনায়তনে সকাল ১০:০০ ঘটিকায় শুরু হয়।
সম্মেলন সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমন্বয়ক শরৎজ্যোতি চাকমা। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদয়ালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বসুমিত্র চাকমা, পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অনিল চাকমা ও পিসিপি’র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নরেশ চাকমা প্রমুখ।
পিসিপি’র চট্টগ্রাম মহানগর শাখার বিদায়ী কমিটির সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চবি শাখার সদস্য সুমন চাকমা এবং প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন খুলশী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক থোয়াইউ প্রু মারমা, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখার সাধারণ সম্পাদক উকিং সাই মারমা, চবি ২ নং গেইট শাখার সদস্য অপূর্ব চাকমা, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক সৌরভ চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুভাষ চাকমা। বার্ষিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেন চবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অন্বেষ চাকমা ও চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অম্লান চাকমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঊষাতন তালুকদার বলেন, “শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নগুলো আগে খুবই সূক্ষ্ম ছিল কিন্তু এখন সেগুলো চোখে পড়ার মতো। এই কঠিন সময়ে আমরা কীভাবে চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি। প্রত্যেকটা ভালো কাজে ত্যাগ-সংগ্রামের প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে। ঠিক একইভাবে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ছাত্র-যুব সমাজকে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হতে হবে। আপনাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষা মানে জ্ঞান অর্জন, আর জ্ঞান মানে বিবেচনা। আমরা আজকে প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষা গ্রহণ করছি তার মাহাত্ম্য তখনই থাকবে যখন আমরা অর্জিত জ্ঞানকে সমাজের কাজে লাগাতে পারব, জাতির অস্তিত্ব রক্ষার কাজে লাগাব। আমাদের জীবন আজ সংকটের মুখে সেটা শিক্ষিত প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে। জুম্ম জনগণ আজ অসহায়ত্ব ও হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলার জন্য ছাত্র সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য নিজের শক্তিতে বিশ্বাস রাখতে হবে। এই শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় কাজে লাগাতে হবে। চুক্তি করেও সরকার কেন অধিকার দিতে চায় না এটা আমাদের বুঝতে হবে। এম এন লারমার আদর্শকে ধারণ করে লড়াই সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে।”
শরৎ জ্যোতি চাকমা বলেন, “আত্মকেন্দ্রিকতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মানুষকে অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে। তাই ছাত্র ও যুব সমাজকে আত্মকেন্দ্রিকতাকে পরিহার করে জাতির সামগ্রিক স্বার্থে ঐতিহাসিক দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার ঐতিহাসিক দায়িত্ব তরুণদের নিতে হবে।”
অনিল চাকমা বলেন, “পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক কান্ডারী সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্র সমাজের মধ্য থেকে আদর্শিক সংগ্রামী নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। যুগে যুগে নিপীড়িত জাতিসমূহের লড়াই-সংগ্রামে তরুণরাই সামনের সারিতে ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনেও এই ছাত্র সমাজের এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।”
নিপন ত্রিপুরা বলেন, “অধিকার আদায় একক কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠী দ্বারা সম্ভব নয়, অধিকার আদায় করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করতে হবে। ‘শিক্ষা গ্রহণ করো, গ্রামে ফিরে চলো’ যে নীতি এম এন লারমা প্রবর্তন করেছিলেন সেই নীতিকে আমাদের ধারণ করতে হবে। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে প্রত্যেককে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি যে শোষণহীন বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবায়নে জুম্ম জনগনকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাহাড়ে চুক্তিবিরোধী যে প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো রয়েছে তারা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন। জেএসএস’র আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী তাদের ব্যবহার করে থাকে। কেবল ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই তারা সমগ্র জুম্ম জনগণের জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। ছাত্র সমাজকে মহান পার্টির ন্যায়সংগত আন্দোলনকে জেনে, প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোকে চিহ্নিত করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সামিল হওয়ার আহ্বান জানাই।’’
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক বাস্তবতায় জুম্ম নারীদের ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে চলেছে। পশ্চাৎপদ জুম্ম নারী সমাজকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। নারী অধিকারের প্রশ্নে সকলকে সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’’
এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিদায়ী বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার বিদায়ী কমিটির সহ-সভাপতি বিনিময় চাকমা ও চবি শাখার বিদায়ী কমিটির সভাপতি নরেশ চাকমা।
এরপর হ্লামিও মারমাকে সভাপতি, অম্লান চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও আদর্শ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, অন্তর চাকমাকে সভাপতি, অন্বেষ চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সুভাষ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, উকিংসাই মারমাকে সভাপতি, পলাশ চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ণজ্যোতি চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখা, সুমন চাকমাকে সভাপতি, আলফ্রেড চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও প্রিয়জ্যোতি চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২নং গেইট শাখার কমিটি ঘোষণা করা হয়।
পিসিপি, চবি শাখা ও চবি ২নং গেইট শাখার নবনির্বাচিত কমিটিকে শপথবাক্য পাঠ করান পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক ম্যাকলিন চাকমা এবং চট্টগ্রাম মহানগর শাখা ও চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখার নবনির্বাচিত কমিটিকে শপথবাক্য পাঠ করান পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি খোকন চাকমা।
পরিশেষে সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।