হিল ভয়েস, ৫ জানুয়ারি ২০২৪, বান্দরবান: বান্দরবান জেলার রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলা এবং রেংখ্যং ভ্যালী অন্তর্গত রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় জেএসএস কর্মীদের টার্গেট করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর উস্কানীমূলক তৎপরতা বেড়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে একটি কায়েমী স্বার্থান্বেষী বিশেষ মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে অনেকে মনে করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার নেতৃত্বে গঠিত ও সেনা-মদদপুষ্ট ‘শান্তি কমিটি’র সাথে মিটিংয়ের পর থেকে বম পার্টি খ্যাত কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শান্তি কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে অনুষ্ঠিত ০৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখের সভায় ঐক্যমত্যের অন্যতম বিষয় ছিল, সংলাপ চলাকালীন কেএনএফ এবং সেনাবাহিনী পরস্পরের উপর কোন আক্রমণ করবে না।
সেই সুযোগ সদ্ব্যবহার করে কেএনএফ এখন মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো ও খুমীদের উপর নানা ধরনের হয়রানিমূলক কার্যক্রম, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে বিনামূল্যে হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু ছিনতাই এবং অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক চাঁদাবাজি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) কর্মীদের প্রতি টার্গেট করে উস্কানীমূলক তৎপরতা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
গত ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ কেএনএফের একদল সশস্ত্র সদস্য বিলাইছড়ির বড়থলি হয়ে সৈকত পাড়ার দিকে চলে যায়। বড় দিনের পর সেই গ্রুপটি আবার একই রাস্তা ধরে বড়থলি হয়ে মিজোরামে চলে যায় বলে জানা গেছে। এসময় তারা জেএসএস কর্মীদের খোঁজ নেয়।
এছাড়া কেএনএফের সদস্যদের সাথে বড়থলি ইউনিয়নের উলুছড়িতে স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুখোমুখী হয়। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জেএসএস কর্মীদের খোঁজখবর নেয়। তাদেরকে দেখেছে বলে এই কথা কারো নিকট ফাঁস করতে বারণ করেছে। অন্যথায় চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে গ্রামবাসীদেরকে হুমকি দিয়ে যায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা। সেসময় বমপার্টি সদস্যরা গ্রামবাসীদের ছবিও তুলে নিয়ে যায়।
এরপর ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে রুমা উপজেলার প্রাংসা ও বটতলি এলাকায় কেএনএফ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। জেএসএস সদস্যদের টার্গেট করতেই কেএনএফের এই তৎপরতা বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের শুক্রমনি পাড়ার জুম এলাকায় কেএনএফ সশস্ত্র সদস্যরা চড়াও হয়। এরপর রেইখ্যং-এর হেইংগ্যছড়া দিয়ে ঠেগা বর্ডার হয়ে মিজোরামে চলে যায়। এসময় কেএনএফের সন্ত্রাসীরা শুক্রমনি পাড়া থেকে জুমচাষীদের কাছ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে ৪/৫ কেজি মুরগীসহ চাল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
সম্প্রতি গত ১-২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে রুমার চাইরাগ্র পাড়া থেকে চাঁদা তুলেছে। এসময় তারা চনুমং মারমা নামে দৈনিক পূর্বকোণের সাংবাদিককে আটক করে এবং তিনি জেএসএসের কাজ করে মর্মে মনগড়া অভিযোগ এনে তাকে হুমকি-ধামকি প্রদান করে।
সূত্র জানায় যে, কেএনএফ ও জেএসএস মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় যদিও গোড়া থেকেই জেএসএস শান্তিপূর্ণ ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের নীতিতে বিশ্বাসী, কিন্তু সাম্প্রতিক সময় জেএসএসের সাংগঠনিক এলাকায় প্রবেশ করে কেএনএফের এই তৎপরতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
গ্রামবাসীদের কাছ থেকে অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদা আদায়, জোরপূর্বক শুকর ও চাল ছিনতাই করা, গ্রামবাসীদের মারধর করা ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর কাছে জানানোর পরেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। কাজেই কেএনএফের এই উস্কানীমূলক তৎপরতার ক্ষেত্রে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই জড়িত রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
আরো জানা গেছে যে, বড় দিন উপলক্ষ্যে গত ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মুন্নাম পাড়ায় সেনাবাহিনী ও কেএনএফের সদস্যদের মধ্যে ভলিবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে কেএনএফ সদস্যরা মুন্নাম পাড়াকে তাদের হেডকোয়ার্টারের মতো ব্যবহার করছে। অথচ রুমা সেনা গ্যারিসন থেকে মুন্নাম পাড়ায় দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। অন্যদিকে সেনা ক্যাম্প থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বেথেল পাড়ায় (রুমা সদর) কেএনএফের সদস্যরা ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ঘুরাফিরা করলেও সেনাবাহিনী দেখেও না দেখার ভান করে থাকে বলে জানা গেছে।
এছাড়া কেএনএফের এই উস্কানীমূলক কার্যক্রমের পেছনে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগেরও ইন্ধন থাকতে পারে অনেকে মনে করেন। কেএনএফের অন্যতম নেতা তলুয়াংথন বমকে রুমার সারণ পাড়ায় সম্প্রতি বান্দরবানে আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী বীর বাহাদুরের সভায় বক্তব্য প্রদানকে তার একটি উদাহরণ বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
এসব উস্কানীমূলক তৎপরতায় কেএনএফের স্বঘোষিত কর্ণেল ভানচুংলিয়ান বম, ক্যাপ্টেন লালসাংরেম বম, সাংপা বম, ক্যাপ্টেন লিয়ানমিং বম, লে: অলিভ বম ও সার্জেন্ট লমলিয়ান বম প্রমুখ ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
মিজোরামের সিপ্পুইয়ের অধিবাসী জনৈক রাইফেল তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তাদের ভাড়াটে সহযোগী। রাইফেল তঞ্চঙ্গ্যার সহযোগিতায় কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জেএসএস সদস্যদের টার্গেট করে এই উস্কানীমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।