হিল ভয়েস, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ঢাকা: আজ মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) বিকাল ৩ টায় রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক এক জুম্ম’র ভূমি বেদখলের অপচেষ্টা এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিবাদকারীদের মারধরের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখা একটি বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে। “বাংলাদেশের ফিলিস্তিন, চিএইচটির খবর নিন” সহ নানা স্লোগানে মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র রাজু ভাষ্কর্য থেকে শুরু হয়ে রোকেয়া হল হয়ে কলাভবন প্রদক্ষিণ করে সমাজ বিজ্ঞান ভবন পেরিয়ে আবার রাজু ভাষ্কর্যে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে পিসিপি, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমার সভাপতিত্বে ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শুভ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
উক্ত প্রতিবাদী মিছিল ও সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাঙ্গামাটির জুরাছড়ির বাসিন্দা শান্তিময় চাকমা, আদিবাসী শ্রমজীবী সমিতির প্রতিনিধি শান্ত চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট’স কাউন্সিলের(বিএমএসসি) কেন্দ্রিয় সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চ্যং ইয়ং ম্রো, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রিয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান নূর, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দীয় সদস্য সতেজ চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রিয় স্টাফ সদস্য মেরিন চাকমা। এছাড়াও সমাবেশে সংহতি জানায় ত্রিপুরা স্টুডেন্ট’স ফোরাম ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি দীপক শীল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রিয় সদস্য মেরিন চাকমা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পরে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তখন আমরা ভেবেছিলাম পাহাড়কে ঘিরে আমাদের সকল আশা-আখাঙ্খা প্রতিফলিত হবে। কিন্তু চুক্তির ২৬ বছর পরে যখন দেখি সেই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হল না। উপরন্তু আমাদের ভূমি প্রতিনিয়ত দখল করা হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধ পাহাড়ের ছাত্র-যুব সমাজ নিশ্চয় তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের দেখানো পথে আবার গর্জে উঠবে।
সমাবেশের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও জুরাছড়ির বাসিন্দা শান্তিময় চাকমা বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের শাসন চলমান রয়েছে। সমতলে গণতন্ত্র আর পাহাড়ে সেনাশাসন। আমরা ভেবেছিলাম বর্তমান সরকার নির্বাচনের পরে একটু হলেও আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সচেতন হবেন। কিন্তু নির্বাচনের পর পরই জুরাছড়ির এইরকম ঘটনা খুবই ন্যাক্কারজনক। আমি পাহাড়ে সকল ভূমি দখল এবং সেনা নিপীড়নের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
সংহতি বক্তব্যে আদিবাসী শ্রমজীবী সমিতির প্রতিনিধি শান্ত চাকমা বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করছি তা ভাবতেই লজ্জ্বা লাগে। পাহাড়ে ভূমি বেদখল, ধর্ষণসহ নানা ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে সেনাবাহিনীরা। পাহাড়ে চলমান রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। যদি পাহাড়ের রাজনৈতিক অবস্থা দিন দিন এভাবে নাজুক করে তোলা হয় তবে জুম্ম তরুণ সমাজও আরো অধিকতর লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পিছ পা হবে না।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট’স কাউন্সিলের কেন্দ্রিয় সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং বলেন, বাংলাদেশে অপরাপর অঞ্চলগুলোতে সেনাশাসন না থাকলেও পাহাড়ে এখনও প্রকটভাবে সেনাশাসন চলমান রয়েছে। ৮০র দশকে চার লক্ষাধিক সেটেলার বাঙালিদেরকে পাহাড়ে পূনবার্সন করা হয়েছিল। বেআইনিভাবে, সেই সেটেলার পূনর্বাসনের প্রক্রিয়া এখনও চলমান। যার উদাহরণ, কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া জুরাছড়ির ঘটনা। এ ঘটনায় পাঁচজন প্রতিবাদকারী যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের কর্মী, তারা সেনাবাহিনীর দ্বারা মারধরের শিকার হলেও রাঙ্গামাটির ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা একটি বিবৃতিও দেয়নি, যা খুবই হতাশাজনক। পাহাড়ের অবস্থাকে দিনকে দিন অস্থিতিশীল করে শান্তিবাহিনীর হাতিয়ারকে আবার গর্জে উঠতে দিবেন না বলেও হুশিয়ারি দেন এই ছাত্রনেতা।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চ্যং ইয়ুং ম্রো বলেন, সেনাশাসনের কারণে পাহাড়ে আমরা শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। বিদেশে আমরা যখন যাই তখন আমাদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। ঠিক একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকতে গেলেও আমাদেরকে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে হয়। নিজের বাড়িতে গেলেও রাস্তায় চেকপোস্টে আমাদেরকে নানারকম অপ্রাসঙ্গিক জিঞ্জাসা করা হয়। বান্দরবানের লামায় রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির মাধ্যমে ম্রোদের যে ভূমি বেদখল করার অপচেষ্টা করা হয় তার বিচার আমরা এখনও পাইনি। আমরা অবিলম্বে পাহাড় থেকে বেআইনিভাবে দখলকৃত পাহাড়ীদের ভূমি ফেরত দেওয়ার জন্য পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করার আহ্বান জানাচ্ছি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন বলেন, পাহাড়ে খুন, অপহরণ, ধর্ষণ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বৈতশাসনের মাধ্যমে পাহাড়ীদেরকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার করানো হচ্ছে। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় স্বোচ্ছার ছিলাম, আছি। জুরাছড়ির ঘটনায় সেনাবাহিনীর নিপীড়ন খুবই হতাশাজনক। সেনাবাহিনীর ওই সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে লড়াই অব্যাহত রাখব।
বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান নূর বলেন, আমরা সবসময় এক দেশ, এক স্বাধীনতা নীতিকে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু পাহাড়ের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ আলাদা। বর্তমান সরকার টানা ৪ বার ক্ষমতায় আসার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। অবিলম্বে ভূমি কমিশন কার্যকর ও পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
পিসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য সতেজ চাকমা বলেন, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে যখন সংসদে পাহাড়ীদেরকে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করা হয় তখন তার প্রতিবাদে জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদ থেকে ওয়াক-আউট করেন। কিন্তু তাঁর কথা শোনা হল না। যার ফলস্বরুপ ১৯৭৬-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হয়।
এই চুক্তির ২৬ বছর পরও মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কাজেই যে ভুল শাসকগোষ্ঠী আরো করতে যাচ্ছে এবং যদি পাহাড়ীদের উপর দমন নিপীড়নের প্রক্রিয়া এভাবে চালু থাকে তাহলে জুম্ম যুব-তরুণরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্বকে কাঁধে তুলে নিতে নিশ্চয় সময় নিবে না। অবিলম্বে বিধিমালা প্রণয়ণ পূর্বক পার্বত্য ভূমি কমিশন কার্যকর করে পাহাড়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আহ্বানও জানান এই ছাত্রনেতা।
সমাবেশের সভাপতির বক্তব্যে পিসিপি, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা বলেন, জুরাছড়ির ঘটনায় আমরা জানতে সক্ষম হয়েছি যে, প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ৩ জনকে এখনও বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। আমরা অনতি বিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি করছি। প্রতিবাদকারীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও উক্ত সংগঠনের কর্মীরা ঘটনার প্রতিবাদে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
জুরাছড়ির ঘটনার মত পাহাড়ে আর এধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা পুনরাবৃত্তি না করার জন্য অবিলম্বে বিধিমালা প্রণয়ন করে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করতে হবে। সকল সমস্যার সমাধান বা পাহাড়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি উক্ত সমাবেশে উপস্থিত অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও উপস্থিতিদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাবেশের ইতি টানেন।