হিল ভয়েস, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ঢাকা : ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বর্তমানে ভূমি বিরোধ, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার এ চুক্তিকে শুধু অগ্রাহ্য করছে না, এটাকে চরম অবহেলাও করছে।
গতকাল (৮ ডিসেম্বর ২০২৩) শুক্রবার সকালে দ্য ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান সম্মেলন কক্ষে ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন ও পার্বত্য ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা’’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন ও এএলআরডি-র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ার অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, সরকার নিজেই আইন করে, চুক্তি করে আবার নিজেই সেই আইন ভঙ্গ করে, চুক্তি ভঙ্গ করে। সরকার যেন চালাক হয়ে উঠছে আর ভাবছে যে জনগণকে বোকা বানিয়ে আইন ও চুক্তি ভঙ্গ করেও নিরাপদে টিকে থাকা যাবে। কিন্তু কোনো অসততা দিয়ে, মোনাফেকি দিয়ে এদেশের মানুষকে বোকা বানানো যায় নি, যাবেও না।
সেমিনারে মূল উপস্থাপন করেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে প্রায়শই সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, দপ্তর হস্তান্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থ ব্যয়ের কথা গর্বভরে উল্লেখ করে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে কোন কোন জায়গায় ব্যর্থতা আছে সেটি সরকার উল্লেখ করে না। চুক্তির মৌলিক বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি, প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, স্থানীয় প্রশাসনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি, কার্যকর ভূমি কমিশন, টাস্কফোর্স কোনো কিছুই হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এখন হুমকির মুখে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কোনোতাই নিরাপত্তার সমস্যা নয়, এই সমস্যা স্বশাসনের, নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রথা ও প্রথাগত ভূমিব্যবস্থাপনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার সমস্যা। সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হবার কথা ছিল, পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়ন সেটিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্য ও নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, বাংলাদেশে যে আধিপত্যবাদ ও নিয়ন্ত্রণবাদের অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে তারই প্রভাব গিয়ে পড়ছে পার্বত্য অঞ্চলে। পার্বত্য অঞ্চলে যে বাঙালি সেটেলারকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তারা রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদকেই সমর্থন করবে। চুক্তির ধারা মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী অস্ত্র সমর্পন করলেও তাদের অধিকার ও দাবী, বিশেষ করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, মানা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ইসরাইল যেমন একটি রাষ্ট্র নয়, একটি প্রকল্প, তেমনি পার্বত্য চুক্তি কোনো চুক্তি নয়, এটি একটি প্রকল্প। পার্বত্য অঞ্চল দখলে রেখে, সেখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণকে ধ্বংস করে আধিপত্যবাদ, পর্যটন, ব্যবসা ও ভূমি দখলের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছে। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধিকার না পায়, স্বাধীন নাগরিক অধিকার ভোগ না করতে পারে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা না পায় তবে বাঙালি মুসলমান ও নাগরিক হিসেবে আমাদেরও মুক্তি নেই, আমাদের স্বাধীনতারও তাৎপর্য নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মূল্যায়নের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে তাতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই সদস্য। চুক্তির আরেকটি পক্ষ জনসংহতি সমিতি, বা পার্বত্য জনগোষ্ঠী ও পরিষদের কাউকে সেই কমিটিতে না রেখে এক তরফাভাবে বলে দেয়া হলো যে ৭২ টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী, শান্তি চুক্তিতে বিশ্বাসী। যতই প্ররোচিত করার চেষ্টা করা হোক না কেন, হামাসের মতো আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে হত্যা, নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনের মুখে ফেলে দিবো না। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন, দখল, আগ্রাসন, সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি প্রান্তিকতায় ঠেলে দেয়া এবং পাহাড় দখল, নাম বদল, জমি দখলের এই ধারা বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. রাণা দাশগুপ্ত বলেন, পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের আগে যে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্মূলের পরিকল্পনা করেছিল তা স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসে এই বাংলাদেশ সেটা বাস্তবায়ন করছে। আমাদের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু তারা আদৌ এই বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত নয়। পার্বত্য চুক্তি সরকার করেছে, সরকারেরই দায়িত্ব চুক্তি বাস্তবায়ন করা। সেটি নাহলে প্রতারক, ধোকাবাজ হিসেবে বদনাম নিতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে, দায় এড়ানো যাবে না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, অতীতে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে মিডিয়াতে যেভাবে লেখা হতো তা এখন আর হয় না, কেন হচ্ছে না, কেন করছে না, তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, বা তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কি না – তা আমরা জানি না। পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের সংলাপ আয়োজনের সুপারিশ করে তিনি বলেন, পার্বত্য আদিবাসীরা গত ২৬ বছর ধরে ধোকার মধ্যে আছে, কেন এই ধোকাবাজি করা হলো তার জবাব চাই।
এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য ভূমি কমিশন হয়েছে, কিন্তু তারা বসতে পারেন না, সভা করতে পারেন না? কেন পারেন না? পার্বত্য চট্টগ্রামের যে আইনগুলো হলো তা কেন বাস্তবায়িত হয় না? এই প্রশ্ন আমাদের করে যেতেই হবে। রাষ্ট্র পাহাড়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকেই অপমানিত করছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কেবলমাত্র রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতাই নয়, আমাদের নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যদি আমরা ঠিকমত পালন করতে পারি তাহলে আজ না হোক, কাল, কাল না হোক তার পরের দিন, একদিন না একদিন এই চুক্তি বাস্তবায়িত হবেই।
সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের অন্যতম যুগ্ম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, বৈচিত্রময়, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যের নীতিতে পরিচালিত না হয় তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুফল পাওয়া যাবে না।