ধীর কুমার চাকমা
কালের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই চুক্তির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতে গেলে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে অদ্যাবধি সরকার ও চুক্তি পক্ষীয় বিভিন্ন মহলের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের অবসান হয়নি এখনো। চুক্তি সম্পাদনকালে যেই শিশুর জন্ম হয়েছে সেই শিশু এখন দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়েছে। হয়েছে একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক অথবা কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন বিষয়ে আজো আন্দোলন, মিছিল সমাবেশ করতে হচ্ছে, হতে হচ্ছে মিথ্যা মামলার শিকার। থাকতে হচ্ছে অনির্দিষ্ট কাল ধরে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্টে। কবে বিচার হবে তার নেই কোন কূলকিনারা।
দিন যতই গড়াচ্ছে ততই গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি, সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। তারই প্রেক্ষিতে ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ ইত্যাদি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন ও বরণীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অপরদিকে জাতীয় পর্যায়ে যতই এই চুক্তি গণতন্ত্রীমনা ব্যাপক জনগণের সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর হয়রানিমূলক টহল অভিযানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সাথে সুর মিলিয়ে সরকারের শাসকগোষ্ঠী চুক্তি বিরোধী ও আদিবাসী জুম্মদের স্বার্থপরিপন্থী নানারকম অপপ্রচারণায় লিপ্ত হচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠছে। উচ্ছেদ আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ।
চুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হবার এই দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন অধিকতর জোরদার করার অঙ্গীকারে আজকে চুক্তির ২৬ বছর পূরতি উদযাপন উপলক্ষে দিনব্যাপী নানারকম কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে। বিদেশের মাটিতেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন জোরদার করার জন্য প্রবাসী জুম্মরাও সংহতি প্রকাশ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মরা ৫১ বছর ব্যাপী এই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের অধিকাংশ সময় যদি ধরা যায় সশস্ত্র আন্দোলনের দুই যুগাধিক কালের চেয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন সময়টা বেশি। এই সময়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে শাসকগোষ্ঠী সদিচ্ছার চেয়ে অসদিচ্ছার বহি:প্রকাশ বেশি ঘটিয়েছে। অধিকন্তু চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম দমনের লক্ষ্যে এ কার্যক্রম জোরদার করার জন্য জুম্ম দিয়ে জুম্ম হটানোর কার্যক্রমে বেশি মনোনিবেশ করেছে শাসকগোষ্ঠীর একটি স্বার্থাণ্বেষী মহল। তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে – মগপার্টি, কেএনএফ ইত্যাদি গঠনের পাঁয়তারা করণ। পরিশেষে তাতেও যখন শেষ রক্ষা হলো না, তখন ভাগ করা শাসন করার নীতি আঁকড়ে ধরে থাকার সিদ্ধান্তে অটল থেকে যখন যা সম্ভব তখন তা করেই আদিবাসী জু্ম্ম বিধ্বংসীর কার্যক্রম বলবৎ রেখেছে বর্তমান সরকারের শাসকগোষ্ঠী।
বর্তমানে একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনসমূহকে পৃষ্ঠপোষক করছে, অন্যদিকে আদিবাসী জুম্মদের আবাসভূমিতে বহিরাগত সেটেলার মুসলিমদের বসতিপ্রদানের কর্মসূচী নিত্য নুতন কায়দায় চালিয়ে নিচ্ছে। শুধুমাত্র জুম্মদের আবাসভূমি নয়, জুম্মদের ধর্ম প্রতিষ্ঠান ( বুদ্ধমন্দির, হিন্দু মন্দির ইত্যাদি) গুড়িয়ে দেয়া হয়। সেখানে রাস্তাঘাট নির্মাণ, ক্যাম্প সম্প্রসারন, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়।
সর্বোপরি জুম্মদের ঘরবাড়ী নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয় ক্যাম্প কম্যান্ডারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে পাকা ঘর নির্মাণ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বাধা প্রদানের মতো মানবাধিকার লঙ্গনের ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে পার্বত্য চুক্তি অনুসারে গঠিত ‘ভূমি কমিশনের’ ভূমিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করেই এসব করা হচ্ছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। সুতরাং চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সরকার ও পার্বত্য চট্গ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিকল্প নেই। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথভাবে বাস্তবায়নই ২৬তম বর্ষপূর্তিতে জুম্ম জনগণের প্রাণের দাবি।