অংম্রান্ট অং
১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ সাল। এই দিনটি জুম্মজাতির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও বিপর্যয়কারী একটি দিন। এই দিনে পার্টির নীতি-আদর্শ বিচ্যুত, ক্ষমতালোভী, বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারী চার কুচক্রী ‘গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ’ এর নেতৃত্বে অবৈধভাবে নেতৃত্ব দখলের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট বিভেদপন্থী এবং প্রতারক চক্রের সশস্ত্র আক্রমণে জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত ও জুম্মজাতির মহান নেতা শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর আট সহকর্মীসহ শহীদ হন। এর ফলে জুম্মজাতি এবং তাদের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী পার্টির প্রধান নেতাকে হারায়। জুম্মজাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন যুগ যুগ ধরে অধিকারহারা, শোষিত ও বঞ্চিত জুম্ম জনগণের সঠিক দর্শনের সন্ধানদাতা ও নীতি-আদর্শের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন আদর্শবান, নীতিবান, জ্ঞানী, ত্যাগী, ক্ষমাশীল, দূরদর্শী, দক্ষ, ভদ্র ও নম্র, শৃঙ্খলাপরায়ণ, চিন্তক, রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও বিপ্লবী। এসব গুণাবলিসম্পন্ন নেতা সত্যি দুর্লভ।
পাকিস্তানি শাসনামলের ১৯৬০ সালে রাঙ্গামাটি জেলার কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করে। এতে জুম্ম জনসাধারণ জমি হারাবে, অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হবে জেনে শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর প্রতিবাদ জানান। এজন্যে তাঁকে ছাত্র অবস্থাতেই কারান্তরীণ হতে হয়। কাপ্তাই বাঁধের ফলে জুম্মদের চুয়ান্ন হাজার একর জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়; দেড় লক্ষেরও অধিক জুম্ম বাস্তুচ্যুত হয় এবং ষাট হাজার চাকমাকে দেশান্তরি হয়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়।
কারামুক্ত হয়ে তিনি ছাত্র শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন এবং পাহাড়ের গ্রামে গিয়ে বিদ্যালয় স্থাপন করেন ও তাতে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে আইন বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আইনজীবী হিসেবে আইন চর্চা শুরু করেন। পাকিস্তানি শাসনামলের শেষের দিকে কিছুটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা ঘোলাটে হতে থাকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্ব শুরু হয়। ১৯৭১ সালে নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে আহুত গণপরিষদের অধিবেশনে শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অংশগ্রহণ করেন এবং দেশের বঞ্চিত ও অধিকারহারা মেহনতি মানুষের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। সংবিধানে সমগ্র দেশের মেহনতি মানুষদের এবং জুম্ম জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি রাখেন। তাছাড়া সংসদের বাইরেও বাংলাদেশের স্থপতি ও সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে জুম্মদের অধিকার সংবিধানিকভাবে রাখার লিখিত দাবি জানান। কিন্তু তাঁর দাবিগুলো প্রত্যাখাত হয়। তাঁর জনস্বার্থমূলক দাবিগুলো শাসকদল আওয়ামী লীগ প্রত্যাখান করে এবং সংবিধানে জুম্মদের অধিকার বাদ রেখে সংবিধান প্রণয়ন সমাপ্ত করে। দেশের শাসনতন্ত্রে মেহনতি মানুষের ও জুম্ম জনগণের অধিকার স্বীকৃতি না পাওয়ায় তিনি সংবিধানে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকেন।
তার সাথে শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মানবের ইতিহাস, সমাজ বিকাশের ইতিহাস এবং বিভিন্ন জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করে যুগ যুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত, অধিকারহারা ও পশ্চাৎপদ অবস্থায় জীবনধারণ করে আসা জুম্মজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ নির্মাণের জন্য পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি জুম্ম জনগণের পার্টি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ গঠন করেন। কেননা, জনগণের লক্ষ্য পরিপূরণ করতে হলে পার্টি দরকার। জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পার্টির কর্মপন্থা ও কর্মসূচি দরকার। তিনি পার্টির জন্য কর্মপন্থা, কর্মসূচি ও পার্টি পরিচালনা পদ্ধতি তৈরি করেন। এভাবে জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নীতি-কৌশল এবং পার্টির মধ্যে নীতি-আদর্শ গড়ে উঠতে থাকে। তার সাথে পার্টিতে ধ্যান-ধারণা চর্চার জন্য এবং নীতি-আদর্শের আহরণের জন্য মানব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রগতিশীল দর্শনকে সংযুক্ত করান। পার্টি ও তার নেতা-কর্মীদের বিপ্লবী ও সংগঠক রূপে গড়ে তোলার জন্য বিপ্লবী আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর সাহিত্য অধ্যয়ন জোরদার করা হয়। তিনি নিজেও সংগঠনের প্রয়োজনে প্রবন্ধ, নীতিমালা ও নির্দেশনা রচনা করেন।
শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে (সংগঠিত করার কর্মকৌশলে, পরিচালনায় ও দিকনির্দেশনায়) পার্টি-সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে, নেতা-কর্মী বৃদ্ধি পেতে থাকে। বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন হয়; আবার গুণগত পরিবর্তন থেকে পরিমাণগত পরিবর্তনও হয়। এটা বস্তুর নিয়ম। নেতার গুণে সংগঠনে কর্মীর সংখ্যা ও সংগঠন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমে এরূপ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হলে তিনি আবারও উত্তরাঞ্চল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশে শাসকদের অহঙ্কার, সংকীর্ণ ও উগ্রতা, ক্ষুদ্র পুঁজিপতি চিন্তাধারার বিকাশ, লোভ-দখল-আত্মসাৎ, ক্ষমতাদম্ভ, মহান চিন্তকদের পরামর্শ গ্রহণ না করা এবং অব্যবস্থাপনার ফলে দেশে অরাজকতার পরিস্থিতি দেখা দেয়। দেশ পরিচালনায় শাসকদল অযোগ্যতার পরিচয় প্রমাণ করে। এ বাস্তবতার এক পর্যায়ে শাসকদলের প্রধান, সরকারের প্রধান এবং দেশ প্রতিষ্ঠাতা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের দ্বারা হত্যার শিকার হন। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। চার জাতীয় নেতা কারাগারে খুন হন। দেশে সামরিক অভ্যূত্থান ও পাল্টা সামরিক অভ্যূত্থান ঘটে। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার রূদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থার মধ্যে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
তাঁর নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে এবং পার্টি-সংগঠন শক্তিশালী হতে থাকে। পার্টির সশস্ত্র আন্দোলন এগিয়ে চলে। পার্টির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের সামরিকবাহিনী যা শান্তিবাহিনীর নামে পরিচিত ও জনপ্রিয় তা সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলিত হয়; এবং সামরিকবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে একটি রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর রূপলাভ করে। পার্টির কার্যক্রমে এবং শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শান্তিবাহিনী সাফল্য লাভ করে। জুম্ম জনগণ তাদের স্বাধিকার-অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশার আলো দেখতে পায়। তারপরেও পার্টির অনেক পরিচালক কর্মী এবং পরিচালিত কর্মীর মধ্যে সামন্তীয় ও ক্ষুদ্র পুঁজিপতির ভাবাদর্শ থেকে যায়; তাঁরা সামন্তীয় ও ক্ষুদ্র পুঁজিপতির ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। তাঁদের মধ্যে ক্ষমতালোভ, স্বার্থলোভ, অজ্ঞানতা, অদূরদর্শিতা, অহঙ্কার, সংগ্রামবিমুখতা, সুবিধাবাদিতা ও ধুরন্ধরি চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরফলে তাঁদের মধ্যে পার্টির প্রধান প্রধান নেতৃত্বপদ দখল করা এবং পার্টিকে তাঁদের আজ্ঞাধীন করার মানসিকতা জন্ম দেয়। এ মানসিকতা থেকে ‘চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ’ পার্টিতে দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করে আসা রণনীতি ও রণকৌশলকে এবং পার্টির প্রধান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আড়ালে-আবডালে নীতিহীন সমালোচনা শুরু করে; উপদলীয় চক্রান্তও তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে।
ধুরন্ধরি সামন্তীয় ও ক্ষুদ্র পুঁজিপতি ভাবাদর্শীরা নিজের মতামত পদ্ধতিগতভাবে পার্টি ব্যবস্থায় তুলে আনে না; সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে না। তাঁরা ভদ্রলোকের ছদ্মবেশ ধরে আড়ালে-আবডালে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো লোকের বিরুদ্ধে নীতিহীন সমালোচনা করে, কুৎসা রটনা করে, ছিদ্রানুসন্ধান করে এবং চরিত্র হনন করে। তাঁরা পার্টির নীতি-আদর্শ চর্চা করে না, যদিও অন্যকে দেখানোর জন্য নীতি-আদর্শ চর্চার ভান করে; সুযোগ পেলে নীতি-আদর্শ চর্চার বিরুদ্ধে বলে, লাভ-অলাভের কথা তোলে। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখতে না পেলে সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে চলে না, পার্টির সিদ্ধান্ত অমান্য করে ও অবহেলা করে। তাঁরা অন্যকেও নীতি-আদর্শহীন করে, স্বার্থবাদী করে; পরিণতিতে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বানিয়ে উপদল তৈরি করে। এই ছিল ধুরন্ধরি সামন্তীয় ও ক্ষুদ্র পুঁজিপতি ভাবাদর্শী কর্মপন্থা।
প্রদীপের আলোর নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি পার্টির সমস্ত সংগঠন ও কর্মীদের মধ্যে পার্টির দর্শন ও নীতি-আদর্শ সমভাবে চর্চা না হওয়ায় এবং পার্টিকর্মীদের যথাযথ পার্টি দর্শন ও নীতি-আদর্শে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম না হওয়ায় পার্টিতেও অন্ধকার দিক থেকে যায়। পার্টি দর্শন ও নীতি-আদর্শ আয়ত্ত না করা এবং পার্টি দর্শন ও নীতি-আদর্শে পিছিয়ে পড়া কর্মীদের সহজে ভুল বোঝানো যায়, সহজে বিপথগামী করা যায়। চার কুচক্রীরা এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে। তাঁরা কূটকৌশল অবলম্বন করে নীতি-আদর্শে দৃঢ় না হওয়া কর্মীদের ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করে এবং নিজেদের উপদলে ভেড়াতে থাকে। এ পর্যায়ে এসে পার্টি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কর্মীরা বিভক্ত হয়ে যায় দুই লাইনে; দীর্ঘমেয়াদী রণনীতির লাইন ও সল্পমেয়াদী রণনীতির লাইন। দীর্ঘমেয়াদী রণনীতির লাইনকে নেতৃত্ব দেয় শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, আর সল্পমেয়াদী রণনীতির লাইনকে নেতৃত্ব দিতো ‘চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ’। ফলে সুশৃঙ্খল পার্টিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সুসংগঠিত পার্টির ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়।
লক্ষ্য করা যায় যে, পার্টিতে তার দর্শন ও নীতি-আদর্শ চর্চা না হলে সেই পার্টির কার্যক্রম সুস্থভাবে চলতে পারে না এবং পার্টি শক্তিশালী হয় না। পার্টি শক্তিশালী না হলে জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে না। অসুস্থ রোগী যেমন নিজের কাজকর্ম করতে পারে না, পার্টিও তাই। পার্টি দর্শন ও নীতি-আদর্শ পার্টিতে রোগের ঔষধ। কর্মসম্পাদনের জন্য পার্টিতে পদ্ধতি আছে, নিয়ম-নীতি আছে, দর্শন-আদর্শ আছে। এগুলোর যথাযথ আয়ত্ত করা পার্টির প্রত্যেক নেতা-কর্মীর একান্ত দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। পার্টির দর্শন ও নীতি-আদর্শ কোনো সদস্যের মধ্যে না থাকলে এবং কর্মপদ্ধতি না জানলে কর্মীর বৈশিষ্ট্য থাকে না; আর কর্মী না হলে নেতা হতে পারে না। আরও লক্ষ্য করা যায়, কোনো কোনো কর্মীর মধ্যে পার্টির দর্শন ও নীতি-আদর্শ রয়েছে, কিন্তু তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে না, দৈনন্দিন কার্যকলাপে তা অনুসরণ করে না। তা-ও প্রকৃত কর্মীর বৈশিষ্ট্য নয়। দর্শন ও নীতি-আদর্শ ব্যক্তির মনের বা চিন্তার ভেতরকার ব্যাপার। মুখে নীতি-আদর্শের কথা বলে কাজের বেলায় নেই; সাংগঠনিক কাজে থাকার সময় নীতি-আদর্শের কথা বলে, কিন্তু সাংগঠনিক কাজে না থাকলে নীতি-আদর্শ ভুলে যাওয়া; তা নীতি-আদর্শের আয়ত্ত করা নয়। এর মানে ব্যক্তির সাথে নীতি-আদর্শের দূরত্ব রয়েছে।
পৃথিবীতে কোনো মানুষ আদর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। প্রগতিশীল আদর্শ না থাকলে তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ আছে। সংগঠনেও কোনো সদস্যের প্রগতিশীল না থাকলে তাঁর প্রতিক্রিয়া আদর্শ আছে। পার্টির দর্শন ও নীতি-আদর্শের শিক্ষা নেওয়ার পরও তা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে তাঁর মধ্যে পরিবর্তন হয়নি; সমাজের আদর্শ তাঁর মধ্যে রয়েছে। এভাবে নীতি-আদর্শের দ্বারা সুসংগঠিত কর্মী হওয়া যায় না এবং নীতি-আদর্শের সুসংগঠিত কর্মী হতে পারে না। আদর্শের পরিবর্তন হতেই হবে। অনেকে রয়েছে নীতি-আদর্শের কথা অনর্গল বলতে পারে, কিন্তু সে নীতি-আদর্শ ধারণ করে না; নীতি-আদর্শের কথা দার্শনিকের মতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু সে নীতি-আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তাই পার্টির নীতি-আদর্শকে শুধু ধারণ-বহন নয়, চায় হৃদয়ঙ্গম করতে পারাও। যে সদস্য পার্টির নীতি-আদর্শ হৃদয়ঙ্গম করে সেই প্রকৃত কর্মী। এই নিরিখে চার কুচক্রী এবং তাদের চক্রে ঢুকে পড়া অন্যান্য সদস্য পার্টির কর্মী হতে পারেনি। তাই তাঁরা পার্টি ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পেরেছে, উপদল গঠন করতে পেরেছে, চক্রান্ত করতে পেরেছে এবং জুম্ম জনগণের মহান নেতাকে হত্যা করতে পেরেছে।
পার্টির ঐক্য পুনঃস্থাপিত করার জন্য ১৯৮২ সালে পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসে দীর্ঘমেয়াদী লাইন জয়যুক্ত হয় এবং নিয়মানুযায়ী পরবর্তী কেন্দ্রিয় কমিটি নির্বাচিত হয়। পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটিতে আবারও সভাপতি নির্বাচিত হন জুম্ম জাতির মহান নেতা শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। কিন্তু আদর্শচ্যুত ও নীতিভ্রষ্ট কুচক্রীরা পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত বেকায়দায় পড়ে মেনে নিলেও, নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারেনি। পার্টিতে ‘ভুলে যাও, ক্ষমা কর’ নীতির ভিত্তিতে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমন সময়ে চক্রপন্থীরা পার্টির সভাপতি শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর ব্যারাক আক্রমণ করে তাঁকেসহ তাঁর আরও আট সহযোদ্ধাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাদের বিশ্বাসঘাকতা সম্পূর্ণ করে। জুম্মজাতি হারায় তাদের মহান নেতাকে। এজন্য ১০ই নভেম্বর জুম্মজাতীয় শোক দিবস।
জাতিতে বা সমাজে অথবা সংগঠনে একটা নীতিবাক্য উচ্চারণ করা হয় ‘শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত কর’। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার উপায় কী? নীতি-আদর্শ চর্চা করা, অর্থাৎ পার্টির নীতি-আদর্শ চর্চা করা। শুধু নীতি-আদর্শ চর্চা করা নয়, নীতি-আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করা; তাকে কাজে, কথায় ও চিন্তায় প্রতিফলন ঘটানো। ভুল চিন্তাধারার বিরোধিতা করা এবং নির্ভুল চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; নিজের রাজনৈতিক মান উন্নতি করা এবং সচেতন শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া; প্রগতিশীলতার জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং প্রতিক্রিয়াশীল জ্ঞান ধ্বংস করা। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল পরিহার করা এবং নির্ভুল হওয়ার চেষ্টা করা।
কর্মীর যোগ্যতার মাপকাঠি হলো- আদর্শের প্রতি একান্ত অনুগত, জনগণের সঙ্গে সংযোগ, স্বাধীনভাবে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের সক্ষমতা ও শৃঙ্খলাপরায়ণতা। কিন্তু দেখা যায়, সংগঠনে ঐক্য সুদৃঢ় না হওয়ায় সাংগঠনিক ঐক্যে ভাঙ্গন ধরে, সংগঠন দুর্বল হয়, সংগঠনের কার্যক্রম এগিয়ে যেতে পারে না। জনগণ ও কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়, জনগণ ও কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে, সংগঠনের শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। সংগঠনকে সুদৃঢ় করার উপায় নীতি-আদর্শের চর্চা। নীতি-আদর্শের চর্চার মাধ্যমে সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। এর বিকল্প নেই।