হিল ভয়েস, ১১ নভেম্বর ২০২৩, বাঘাইছড়ি: রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়িতে জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মহান নেতা এম এন লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল ১০ নভেম্বর ২০২৩ বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩১নং খেদারমারা ইউনিয়নে এ দিবসটি পালন করা হয়।
গতকাল সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাঘাইছড়ি থানা শাখা, মহিলা সমিতি সহ খেদারমারা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম শাখা ও সংস্থার পক্ষ থেকে এম এন লারমা সহ শহীদদের স্মরণে শহীদ বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শোক সভার মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।
খেদারমারা ইউনিয়নবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত সভায় ৩১ নং খেদারমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্টু চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কাচালং সরকারি ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ দেব প্রসাদ দেওয়ান এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাঘাইছড়ির চার ইউনিয়নের (৩০,৩১,৩২ ও ৩৩ নং ইউপি) ইউপি চেয়ারম্যান, কাচালং বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভদ্রসেন চাকমাসহ স্থানীয় বিভিন্ন হেডম্যান, কার্বারী ও জনপ্রতিনিধিবৃন্দ।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে কাচালং সরকারি ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ দেব প্রসাদ দেওয়ান বলেন, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিতে ঐতিহাসিক বাঁকে বাঁকে, যুগে যুগে এমন কয়েকজন মহান পুরুষের আবির্ভাব হয় যাঁরা দেশকে, জাতিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন। জুম্ম জাতির পথ প্রদর্শক এম এন লারমাও তেমনই একজন মানুষ যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুমন্ত ১৩ ভাষাভাষী ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। এবং শুধু জাগিয়ে তোলেননি, বেঁচে থাকার পথও দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আজকে এম এন লারমার মৃত্যুবার্ষিকীর ৪০ বছরেও অনেকেই এম এন লারমার মৃত্যুবার্ষিকীতে যোগ দিতে ভয় পায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। একটি বিশেষ মহল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা না বলার জন্য জুম্মদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকে। কিন্তু আমি তাদের বলতে চাই, ভয়ের কোন কারণ নেই। যেদিন মহান জাতীয় সংসদে এম এন লারমার শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সেদিন এই দিবসটি বাংলাদেশের আইনে বৈধতা লাভ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস রেখে, দেশের অখণ্ডতাকে স্বীকার করে যেদিন ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল সেদিনই এই চুক্তিটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে বৈধতা পেয়েছে। কাজেই এই দুইটা দিবস পালন মোটেও অবৈধ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলা মোটেও রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা বলেন, ‘বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে একটু বেশি বিশ্বাস করে জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু আজকে চুক্তির ২৫ বছরে এসে দেখি আমাদের হিসাবের খাতাটা যেই খালি, সেই খালিই পড়ে আছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো একটাও বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাৎ প্রতারণা করেছে সরকার। চরম প্রতারণা করেছে আমাদের সাথে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ভবিষ্যতে টিকে থাকতে হলে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প, পেশায় নিজেদের দক্ষ করতে হবে। বহুগুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রী ভদ্রসেন চাকমা বলেন, ‘এম এন লারমা শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত জুম্ম জনগণের নেতা নন, তিনি সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন। এবং সারা বিশ্বের পীড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ে তিনি দেশে-বিদেশের সেইসব শাসনযন্ত্রের কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। আর তারই ফলস্বরূপ ১৯৮৩ সালের আজকের এই দিনে ১০ই নভেম্বর তারিখে দেশী-বিদেশী ও বিভিন্ন কুচক্রী মহলের পৈশাচিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্মমভাবে খুন হন।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, ৩৩ নং মারিশ্যা ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আপন চাকমা, সঞ্চালনা করেন জ্ঞান আলো চাকমা ও রুপেল চাকমা এবং শোক প্রস্তাব পাঠ করেন মহিলা কার্বারী সূচনা চাকমা।