হিল ভয়েস, ১১ নভেম্বর ২০২৩, ঢাকা: গতকাল ১০ নভেম্বর ২০২৩, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বিকাল ৩:০০ টায় জুম্ম জাতির অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পন, স্মরণ সভা, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও প্রতিবাদী গানের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পালন কমিটির আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। প্রথমেই জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামালের নেতৃত্বে এম এন লারমার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপরে মহান নেতা এম এন লারমা ও তাঁর সাথে শহীদ সহযোদ্ধাদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সূচনা সঙ্গীত পরিবেশনা করেন সঙ্গীত শিল্পী তুহিন কান্তি দাশ। এরপর এম এন লারমার জীবনী পাঠ করেন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। স্মরণসভায় আরো বক্তব্য রাখেন লেখক ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ জাসদ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য নাসিরুল হক নওয়াব, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি সাঈফুজ্জামান বাদশা, ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম সবুর, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি, এমপি রাশেদ খান মেনন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজিন তিতিল বলেন, এম এন লারমা একদিনেই বিপ্লবী হয়ে উঠেননি। তিনি দীর্ঘকাল জুম্ম জাতির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭২সালের সংবিধানে জুম্ম জাতিকে বাঙালী হিসেবে উল্লেখ করায় তিনি সংসদ কক্ষ ত্যাগ করেন। মূলত জুম্মদেরকে বাঙালি বানানোর বিরুদ্ধেই এম এন লারমা প্রতিবাদ করেন। যার মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় আমরা পাই। তিনি সংসদে শুধু নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কথা বলেননি, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের কথাও তুলে ধরেছেন।
জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল এম এন লারমার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হবে যেটা হবে সবার। কিন্তু আমাদের কথার সাথে কাজের কেন ভিন্নতা? আমরা এত ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে দেশটিকে স্বাধীন করলাম কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীতে আমরা সব মানুষকে নিজের করতে পারলাম না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নিজের অধিকারবোধের পাশাপাশি অন্যের অধিকারবোধের কথাও চিন্তা করতে হবে। যেভাবে আমরা মানবাধিকারের ধারণাটি পাই। ব্যক্তির স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে আমরা অনেক সাহসী মানুষদের কথা ভুলিয়ে দিচ্ছি। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকেও আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের মহান নেতা এম এন লারমাকে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এম এন লারমার বায়োপিক তৈরি করতে হবে।
লেখক ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, এম এন লারমার শোষিতের জন্য সংগ্রাম এখনও জারি আছে। তার দূরদর্শীতার পরিচয় হচ্ছে সবাইকে বাঙালী বলার পরিবর্তে বাংলাদেশী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দাবি তোলা। স্বাধীনতার উত্তর প্রজন্ম আজ অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদের আলিঙ্গন করে বলেই স্লোগান তুলছে- তুমি কে আমি কে? বাঙালী আদিবাসী। যা সংবিধানে করা হয়নি। যদিও আমাদের সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। উল্টো তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি করা হয়েছে। বাঙালী মনস্তত্ব থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রথম সংগ্রাম শুরু করেন মহান নেতা এম এন লারমা। দেশটা সব মানুষের, সব ধর্মের হলেও বাঙালীরা সংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগুরু। তাই বাঙালীদেরকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এম এন লারমা পড়ালেখার বয়সেই প্রগতিশীল সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি জুম পাহাড়ের মানুষদের কথার পাশাপাশি দেশের নিপীড়িত সকল মানুষের অধিকারের কথাও বলেন। ১৯৯৭ সালে যে পার্বত্য চুক্তি হল সেটি বর্তমান সরকারের সাথে হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় থাকার পরেও চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনের মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় রাখা হয়েছে। সংবিধানে যতক্ষণ না পর্যন্ত আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিক আন্দোলন করব। এই দায়িত্বটি আমাদের সবাইকে পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ জাসদ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য নাসিরুল হক নওয়াব বলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই পার্বত্যবাসীদের সাথে আমার যোগাযোগ গভীর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাহাড়ী অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির পরেও শান্তি আসে নাই। পাহাড়ের সকল জাতিদেরকে সম্মিলিত করে আরও জোরালো সংগ্রাম করতে হবে।
এরপর এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, এম এন লারমা তাঁর জীবনে ব্যক্তি আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দেননি বরং জুম্ম জাতির জন্য সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। তিনি জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বীরের মত। অনেক জাতির আবাসভূমী আমাদের বাংলাদেশ। আমরা এই পরিচয়টা দিতে দ্বিধান্বিত হই। আমরা বাঙালী বাদে অন্যান্যদেরকে গুরুত্ব দেওয়ার বোধটা সৃষ্টি করতে পারিনি। ঠিক এর বিরুদ্ধেই ছিল এম এন লারমার সংগ্রাম। তিনি শুধু জুম্ম জাতির নয়, বাংলাদেশের নয়, তিনি পুরো পৃথিবীর নেতা। পার্বত্য চুক্তি কিছুটা বাস্তবায়ন হয়েছে। তারপর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত আছে । এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন না হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে, বহুজাতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না।
জাসদ নেতা সাঈফুজ্জামান বাদশা বলেন, পার্বত্য চুক্তি হয়েছে কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন নাই। কেন এইরকম হবে? এর কি কারণ? এই যে বৈষম্য, এটাই অশান্তির মূল কারণ। বাঙালী আদিবাসী সকলেই যেন একজন মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে পারি। বাঙালি-আদিবাসীর ঐকবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবো।
ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম সবুর বলেন, আমরা যখন কোনো মানুষের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি তখন তাঁর কৃতকর্মের বিষয়গুলো আলোচনা করি এবং তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম পূরণ করে তা নিয়ে ভাবি। এম এন লারমা তিনি তাঁর ভাষার অধিকার, ভূমির অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার জাতীয়ভাবে দাবি করেছেন। তিনি এইসবের ক্ষেত্রে সফল। কেননা তিনি আদিবাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছেন, প্রয়োজনে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটা জাতি যদি তার ভাষার স্বীকৃতি, সংস্কৃতির স্বীকৃতি না পাই পরে দ্রোহী হয়ে ওঠে। দ্রোহ থেকে বিদ্রোহ এবং সবশেষে সশস্ত্র আন্দোলনে রুপ নেয়। সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা এম এন লারমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং তাঁর যে অসমাপ্ত কাজ আমাদের সবাইকে সমাপ্ত করতে হবে।
এরপর বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি, এমপি রাশেদ খান মেনন মহান নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমি তাঁকে জাতীয় নেতা হিসেবে বলি কারণ তিনি শুধু আদিবাসীদের কথায় নয় বরং পুরো বাংলাদেশের অবস্থাকে কিভাবে পরিশুদ্ধ করা যায় সেইসব কথায় তুলে ধরেছিলেন। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ীদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা এখন বিনষ্ট করার পায়তারা করা হচ্ছে। ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম দেওয়া হয়েছে। এভাবেই পাহাড়ের অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ করা হচ্ছে। আমি আশা করি নতুন প্রজন্ম এম এন লারমার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবে।
আলোচকদের বক্তব্যের পরেই কবিতা আবৃত্তির সাথে সাথেই মহান নেতা এম এন লারমার স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। অনুষ্ঠানে মহান নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডির, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক সংসদ, দীপক শীলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সাভারের শ্রমিক বন্ধুরা, বাসদের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, কাপেং ফাউন্ডেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল, সামাজিক আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্রাবাস, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ ও বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষকবৃন্দ।