সুমন মারমা ও সোহেল তঞ্চঙ্গ্যা
বর্তমান তরুণ সমাজ অধিকাংশ শহরমুখী। সমাজে চিন্তাধারার পশ্চাদপদতা ও আর্থিক দৈন্যতার কারণে শহরমুখী হয়ে পড়ছে জুম্ম তরুণ সমাজ। অধ্যয়নরত ছাত্ররাও সমাজ সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নয়। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ পরিণতিতে শিশুদের পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের শহরে ভর্তি করিয়ে পড়াশুনা করাতে চায়। অনেক পিতা-মাতার সন্তান জন্ম শহরাঞ্চলে। বেড়ে উঠছে শহরে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল সম্পর্কে তাদের আবেগ-অনুভূতি সন্তোষজনক নয়। লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কেও তাদের কাছে সঠিক তথ্য ও ধারণা নেই। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিস্তৃতি ঘটলে দু’একটা ঘটনা প্রবাহ জানার সুযোগ থাকলেও আড়ালে থেকে যাচ্ছে মূল সমস্যা। পাহাড়ের মূল সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা। সে বিষয়ে শহরে বেড়ে উঠা তরুণদের মাঝে বিশদ জ্ঞান যেমন নেই, জানার আগ্রহও লক্ষ করা যায় না। তবে কি আমাদের ভবিষ্যত রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে ভাবনা তৈরি হতে পারে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও প্রয়াত নেতা এম এন লারমা’র চিন্তাধারা ও আদর্শ চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়ার ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব কারা নিবে এমন প্রশ্নও আসা স্বাভাবিক। তবে তরুণ প্রজন্মও এ দায় এড়াতে পারে না সত্য। এম এন লারমা’র চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেয়ার প্রশ্নে কয়েকভাবে কাজ করা যেতে পারে। গ্রামে, শহরে, জাতীয় ও আন্তজার্তিক পযার্য়ে। শহর এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকুরীরত প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়াত নেতার দর্শন ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে গ্রাম এলাকাগুলো। কারণ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মূল শক্তি গ্রামেই থাকে।
বিপ্লবী চে গুয়েভারা বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেছিলেন অল্প সংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে। আন্দোলন শুরুর অঞ্চল ছিল গ্রাম। চীনা সমাজে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়েছিল গ্রামে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাউস, পেরু ইত্যাদী দেশে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সূত্রপাত গ্রাম অঞ্চল থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল গ্রামে। এম এন লারমা’র নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে জুম্মদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের শুরুতে ৫ জন সদস্য থাকলেও তা ৫০ হাজার জনে দাঁড়িয়েছিল সে সংখ্যা। তাছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন গ্রাম থেকে শহরে দিকে হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকারকামী মানুষ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠাকাল হতে এ যাবত প্রায় ছয় দশক ধরে জুম্মদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সেসময়েও তরুণরাই দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিল। তাহলে বর্তমান তরুণরা কেন পারবে না। তাই প্রয়াত নেতার দর্শন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
গ্রামে গেলে বুঝা যায় আন্দোলন সম্পর্কে কতটুকু জানতে উদগ্রীব সাধারণ মানুষ। ঠিক সে জায়গায় একজন সাধারণ মানুষ যা চায় সে বিষয়ে ধারণা দেবার যোগ্যতা অর্জনে সচেষ্ট থাকতে হবে আমাদের। প্রত্যেক তরুণকে নিজ নিজ সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্তে যেতে হবে। চাষাকে চাষাবাদ সম্পর্কে সহায়তা দিতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত কৃষির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ফলজ, বনজ ও ঔষধি বনায়নকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেসকল গাছ প্রকৃতির জন্য অনুকূল নয় যেমন— রাবার, সেগুন এসব গাছের বনায়নকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। জুম চাষে আরও কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে উচ্চ ফলন পাওয়া যায় সে পরামর্শ দিতে হবে। জুম্ম তরুণদের মধ্যে অনেকে আছে যারা কৃষিতে অনার্স ও ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেয়। ডিগ্রী নেয়ার পর সেসকল তরুণ কোথায় যায় প্রশ্ন করার আগে তাদের মানসিকতাও যাচাই করা উচিত। কৃষিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করার অসামর্থ্য হওয়ায় আমাদের চাষারা এখনও আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। অসংখ্য জুম্ম তরুণ কৃষিতে পড়াশুনা করার বিষয়কে কাজে না লাগিয়ে হয়ে যাচ্ছে চাকুরীজীবী। আমাদের সমাজে কৃষি নিয়ে গবেষণা হয় না। এদিক থেকে আমাদের উচিত হবে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লব্ধ জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করা।
জুম্ম তরুণদের একটি বিরাট অংশ মেডিক্যাল বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে। কেউ নার্সিং এ পড়ছে, কেউ প্যারামেডিক্যালে, আবার কেউ মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তন্মধ্যে মেডিক্যালের নানা বিভাগে অধ্যয়ন করে থাকে ছাত্ররা। চার-পাঁচটা বছরের পর কোথায় যায় এত চিকিৎসক। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক মানুষ আছে যারা অবৈজ্ঞানিক পন্থায় চিকিৎসা নিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। হয়তো বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিতে অসমর্থ। দারিদ্রতা অনেক সময় সুচিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে। রাষ্ট্রও ব্যর্থ হয়েছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করতে। এই জায়গা থেকে আমার মত হলো জুম্ম তরুণরা যারা বছরে বছরে ডাক্তার হয়ে পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে অন্তত উদ্যোগ নিতে পারে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়া। সাজেকে ডায়রিয়া হয়ে মানুষ মারা যায়, থানছিতে ম্যালেরিয়া হয়ে মানুষ মারা যায়। লামায় ডায়রিয়া ও টাইফয়েড হয়ে মানুষ যায়, অন্তসত্তা অবস্থায় মা ও শিশু মারা যায়, সাপের কামড়ে মানুষ মারা যায়। যদি জুম্ম তরুণ ডাক্তার ও সেবকগণ গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য একটা দিন ব্যয় করতো এসব মারা যাওয়ার ঘটনা কমে আসতো।
মোটা অংকের টাকা বিনিময় করে শিক্ষক পেশায় যুক্ত হয় আমাদের জুম্ম তরুণরা। যারা বিত্তশালী বা অর্থবিত্ত রয়েছে তারাই হয়তো শিক্ষক পেশায় প্রবেশ করতে পারে এটা বর্তমান প্রজন্মের উদ্বিগ্নের বিষয়। অভিযোগের ঝুড়িও বিশাল। অনেকেই ধারদেনা করে চাকুরি নিয়ে থাকে। তবে তারা শিক্ষকতা চাকরি নিয়ে গ্রামে যায় কি। অধিকাংশ শিক্ষক “বর্গার শিক্ষক” দিয়ে শহরে বসে বেতন ভোগ করেন। এতে করে প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে দূরে রয়ে যাচ্ছে গ্রামের শিশুরা। অনেক জুম্ম তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি উদ্যোগ নিয়ে গ্রামে গিয়ে কোমলমতি শিশুদের পড়িয়ে আসতে পারে। এতে করে ঝড়ে পড়ার প্রবণতা বহুলাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি বর্গা দিয়ে শিক্ষকতা করা চাকুরিজীবীদেরও সতর্ক করে দেয়া উচিত যাতে শিক্ষকতা গ্রামে থেকে করেন।
বর্তমান জুম্ম তরুণ প্রজন্ম প্রবলভাবে মাদকাসক্ত। মাদকের প্রভাবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের মতো নীতিবর্জিত ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। পরস্পরের মধ্যে নীতিমূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও নূন্যতম নৈতিকতার জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিপ্লবী আদর্শ দূরের কথা আদর্শবান মানুষ হতে পারছে না আমাদের তরুণ প্রজন্ম। সমাজে থাকতে গিয়ে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠছে না। আমি কোন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছি সে কথাও ভুলে যেতে বসেছি আমরা। সংস্কৃতি চর্চা থেকে বিরত থাকছি। প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চা হোক আমার শেকড়কে ধরে রাখার মূলাধার এই মন্ত্রে দীক্ষা নিতে হবে আমাদের। বুজোর্য়াদের দেখানো ও শেখানো সংস্কৃতি কখনও আমাদের আত্মার বন্ধন তৈরি করতে পারে না। তাই জুম্ম তরুণদের উচিত হবে গ্রামে গিয়ে প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চা করা। ভিন্ন ভিন্ন উপকথা, লোককথা, গল্প, ইতিহাস ও গান ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পরিচয়কে উপস্থাপন করে। অনেকেই আছেন নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। হারিয়ে যাওয়া সেসব সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তরুন সমাজের। অন্তত যারা সব কিছু হারাতে বসেছে গ্রামে গিয়ে সে বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করা উচিত।
জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম জোরদার করার জন্য গ্রামে চলো নীতি ফলপ্রসু হয়ে থাকে। শুধুমাত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নয় প্রতিটা বিপ্লবী আন্দোলনও সূচিত হয় গ্রাম থেকে। তার কারণ হলো, শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে ফাঁকি দিয়ে আন্দোলন করার সবচে নির্ভরযোগ্য পরিবেশ হলো এই গ্রাম। গ্রামে অধিকাংশ মানুষ শোষণ মুক্তির আন্দোলনের পক্ষে থাকে। কৃষক থেকে শুরু করে আন্দোলনের মূল শক্তি গ্রামে অবস্থান করে। শহরের তুলনায় অভিজাত শ্রেণি গ্রামে খুব নগণ্য। অভিজাত শ্রেণি আন্দোলন সম্পর্কে মোটেও আন্দোলন বান্ধব নয়। সুবিধাবাদ ও স্বার্থবাদ বেশি কাজ করে শহুরে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। তাছাড়া গ্রামের পাহাড়, বন, নদী ও আবহাওয়া সবকিছু আন্দোলনের জন্য পরম বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হয়। বিপ্লবী সংস্কৃতি চর্চা, বিপ্লবী শিক্ষা গ্রহণ, বিপ্লবী কর্মকৌশল পরিকল্পনা করা আদতে গ্রামে উপযোগী স্থান বলে ধারণা করা হয়।
সাধনাই ফসল। প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে প্রগতিশীল আদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের হৃদয়কে জাগিয়ে তুলেছেন। অন্ধকারাছন্ন সমাজে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিছিন্ন হয়ে থাকা জুম্ম জাতিসমূহকে একত্র করে জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া জাতিকে অধিকার সম্পর্কে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সমাজে লুকিয়ে থাকা সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারাকে চিরতরে বিদায় দিতে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার সম্পর্কে কতজনে জানে বা জানার চেষ্টা করেছে। বর্তমান তরুণ সমাজে ব্যক্তিস্বার্থ ও সুবিধাবাদ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সে সমাজে প্রয়াত নেতার চিন্তাধারা, নীতি ও আদর্শ কতটুকু জরুরী তরুণ সমাজকে জোর দিয়ে ভাবা উচিত। গ্রামে গিয়ে খেটে খাওয়া, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য কাজ করা উচিত। তাই তরুণ সমাজকে নি:স্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। তাছাড়া গ্রামে লুকিয়ে থাকা সমাজ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধেও লড়াই করার জন্য গ্রামীণ মানুষকে সংগঠিত করতে হবে বর্তমান জুম্ম তরুণদের।
পাহাড়, নদী, বন ও প্রকৃতিকে বন্ধু বানিয়ে সংগ্রাম ও লড়াইয়ের অনুকূল করতে হবে। যেখানে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে, তৈরি করতে হবে ও গন্তব্যে পৌঁছার অনুপ্রেরণা দিতে হবে। চৌকষ বাহিনী হয়ে উঠতে হবে। এক একজন যোদ্ধা, সংগঠক ও প্রশাসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে প্রয়াত নেতার চিন্তাধারা প্রতিটা পাহাড়ে পৌঁছে দিতে। যারা ডাক্তারী নিয়ে পড়াশুনা করছে তারা যাতে ডাক্তার হবার পর গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা দেয় সে ধরণের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বিষয়ভিত্তিক নিয়ে যারা পড়াশুনা করছে তাদের প্রত্যেককে গ্রামে গিয়ে অন্তত একটা দিন সময় নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করা। এতে জুম্মরা লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে উপকৃত হবে তেমনি জীবন মান উন্নত করতে পারবে। তার পাশাপাশি যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পড়াশুনা করছে তাদের গ্রামে গিয়ে বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান আহরণ করতে হবে।
তারুণ্য মানে এক নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। তারুণ্য মানে শত বাঁধা উপেক্ষা করে উদ্দামতা সাগর পাড়ি দেওয়ার এক দুঃসাহসিকা। যেখানে চোখ পড়বে সেখানেই তারুণ্যের জয়গান। তাইতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল।”ইতিহাস প্রমাণ করে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় এই তরুণ ছাত্র ও যুবকদের হাত ধরে। তারাই নতুনত্বকে ইতিহাসে স্থান দিয়েছে। পৃথিবীর যতসব অসাধ্য সাধন সবই ঘটেছে এই তারুণ্যের ভাবনায়। হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ হতে মহাকাশ জয়, বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লব হতে চে গুয়েভারার কিউবা বিপ্লব সবই সংঘটিত হয়েছে এই তারুণ্যের শক্তিতে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের রয়েছে এক সংগ্রামী ইতিহাস। যে ইতিহাস প্রতিবাদী বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এক যুবকের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তার লাভ করেছিল। যাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে অগ্রদূত ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তারুণ্যের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি হলেন মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকারহারা জুম্মদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনিয়াদ করেছিলেন। সংগঠিত করেছিলেন পাহাড়ে থাকা বিশাল তারুণ্য শক্তিকে। সেই সময়কার সামন্তবাদের রক্ষণশীল ও অদূরদর্শী চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী চিন্তায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুবকদের ভাবনার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম আরম্ভ করেছিলেন অধিকারহারা জুম্মদের আশা জাগানিয়ার গান।
বিশ্বে যেসব আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেইসব আন্দোলনে যেমনি প্রগতিশীল শ্রেণি বিদ্যমান ছিল তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিও ছিল। এইসব আন্দোলন কোনটি সাফল্য লাভ করেছে আবার কোনোটি হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। পার্টির মধ্যে ছিল সেই সব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। যারা সর্বদা ক্ষমতা লোভ তথা অর্থের পেছনে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল। যারা নিজ জাতির এবং আন্দোলন বিষয়ে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা ও দূরদর্শী চিন্তা করেনি।
১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দূর্যোগপূর্ণ দিন। এই দিনে চার কুচক্রী বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধি ও কায়েমী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হীন ষড়যন্ত্রে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তারা জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত এই মহান নেতাসহ মোট আট জনকে গভীর রাতে নির্মম ভাবে হত্যা করে। যার ফলে জুম্ম জাতি হারায় তাদের একমাত্র দিক নিদের্শক এই মহান নেতাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছর অতিক্রম করেছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনও ৫০ এর অধিক সময় পার করছে। কিন্তু এখনো জুম্ম জনগণের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়নি।
একদিকে উগ্র মৌলবাদী মুসলিম ধর্মান্ধ এবং উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদ আগ্রাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তার লাভ করেই চলেছে অন্যদিকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অস্বস্তিশীল পরিবেশ ও সামরিকায়ন জিইয়ে রাখা হয়েছে। যার ফলে এখানে প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীদের লালন পালনের মাধ্যমে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। জার্মান দার্শনিক কার্ল মাক্সের তার বিখ্যাত দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ তত্ত্বে বলেন, “বস্তুর বিকাশের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বস্তুর আভ্যন্তরীণ গুণ থেকে”। মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তু তার চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে বস্তুর আভ্যন্তরীণ সত্তা থেকে। বস্তুটি যদি তার আভ্যন্তরীণভাবে বিকাশ লাভ করার গুণ না থাকে তাহলে যতই বাহ্যিকভাবে বিকাশ লাভ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হোক না কেন সেই বস্তুটি বিকাশ লাভ করতে অক্ষম। অনুরূপভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জণগণের মুক্তির আন্দোলনের গতি পথ হচ্ছে বর্তমান তরুন সমাজ। তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হয়েছে।
একটি বিখ্যাত উক্তি -“এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।”এই উক্তির প্রেক্ষিতে গ্রামে গিয়ে জুম্ম জনগণের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে তরুণদের সামিল হবার উদাত্ত আহ্বান রইল। ১০ নভেম্বর অমর হোক। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জয় অনিবার্য।