হিল ভয়েস, ২২ অক্টোবর ২০২৩, রাঙ্গামাটি: আজ সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় সময় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, লংগদু থানা শাখার উদ্দ্যোগে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র ও যুব সমাজ অধিকতর সামিল হউন” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে লংগদু উপজেলার বগাচতর এলাকায় এক ছাত্র ও যুব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক রিন্তুমনি চাকমার সঞ্চালনায় ও সভাপতি রিকেন চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি লংগদু থানা কমিটির ভূমি ও কৃষি বিষয়ক সম্পাদক বিনয় প্রসাদ কার্বারি, পিসিপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি লংগদু থানা কমিটির সভাপতি দয়াল কান্তি চাকমা, রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক টিকেল চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক রনেল চাকমা, ও ৯নং মারিচ্যাচর মৌজার মহিলা কার্বারী নতুনা চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি লংগদু থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাধন জীবন চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির লংগদু থানার ভূমি ও কৃষি বিষয়ক সম্পাদক বিনয় প্রসাদ কার্বারী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের নিজ ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র পাকিস্তানি শাসন আমল থেকে শুরু হয়েছিল যা আজ অবধি চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠী বৃটিশ শাসনামলে নিজের স্বাধীনতাকে হারিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনের প্রথাগত ভূমির অধিকার নিশ্চিত ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার তখনো খর্ব করা হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কেউই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্রদের আপন করে নিতে পারেনি। যার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও জুম্ম জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুব সমাজ যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অধ্যয়ন না করে রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হয় তবে অচিরেই জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ধ্বংস হবে। সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করতে হবে এবং তার জন্য জুম্ম ছাত্র ও সমাজকে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে বলে আহ্বান জানান।
পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা পাহাড়িদের ভূমি বিরোধ সমস্যার সমাধান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা সরকার প্রণয়ন করেনি।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো দলীয়করণের ফলে যথাযথ জবাবদিহিতার অভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি লংগদু থানা কমিটির সভাপতি দয়াল কান্তি চাকমা বলেন, ১৯৮৯ সালের ৪ মে লংগদুতে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম। এই গৌরবময় ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
সমাবেশে পিসিপি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রনেল চাকমা বলেন, আজকের অধিকাংশ ছাত্র ও যুবসমাজ জুম্ম জাতির ইতিহাস জানেনা ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির ইতিহাস তাদের জানা দরকার। পার্বত্য চুক্তির মধ্যে তাদের অধিকার নিহিত হয়েছে কিনা তা জানতে হবে। আজকের যে ছাত্র সমাজ আগামী দিনের ভবিষ্যত, একজন ছাত্রের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা অর্জন করা জরুরি। শুধু শিক্ষা গ্রহণ করলে হবেনা, তার পাশাপাশি সমাজ ও জাতিকে শিক্ষিত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করে দিয়ে সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। সেজন্য ছাত্র ও যুব সমাজকে এমএন লারমার সঠিক নীতি আদর্শের ভিত্তিতে সংগ্রামে যুক্ত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক টিকেল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও সরকার চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন না করে চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রচার করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের যথাযথ আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ সরকার এখনো গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা, স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে পুলিশ বাহিনী গঠন করে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংশোধন করা, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো সরকার বাস্তবায়ন করেনি।
৯নং মারিচ্যাচর মৌজার মহিলা কার্বারী নতুনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের গৌরবময় লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত জুম্ম নারী সমাজকে স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জুম্ম নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সমাবেশে সবার শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, লংগদু থানা শাখার সভাপতি রিকেন চাকমার সমাপনী বক্তব্যর মধ্যে দিয়ে সমাবেশ ইতি টানা হয়।