হিল ভয়েস, ৩১ অক্টোবর ২০২৩, চট্টগ্রাম: খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে তিনজন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক আদিবাসী নারীকে গণধর্ষণ ও রাঙ্গামাটির লংগদুতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক আদিবাসী স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার প্রতিবাদে এবং ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
গতকাল সোমবার (৩০ অক্টোবর) নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে দুপুর ৩:০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি দিশান তঞ্চঙ্গ্যা, সাধারণ সম্পাদক জগৎজ্যোতি চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক হ্লামিউ মারমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি পাভেল ত্রিপুরা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অন্বেষ চাকমা প্রমুখ।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অম্লান চাকমা এবং সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সভাপতি বিনিময় চাকমা।
দিশান তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাহাড়ী জনগণ অংশগ্রহণ করেও বর্তমান সময়ে এসে অর্জিত সেই স্বাধীনতার স্বাদ তারা নিতে পারছেন না। পাহাড়ে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক যেসব গণহত্যা হয় সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর মদদ ছিল। আমরা দেখি, আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করলেও তারা কয়েক মাস পরে মুক্তি পেয়ে যায়। যা দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই অংশ।
জগৎ জ্যোতি চাকমা বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চুক্তিকে অবাস্তবায়িত রেখেছে। চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার, জীবনের নিশ্চয়তা ও আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা এখন নেই। সেখানে প্রতিনিয়ত ভয়, অনিরাপত্তার সাথে তাদের থাকতে হচ্ছে। বিগত কিছু দিন আগের ধর্ষণ ঘটনাও তার একটি চিত্র। পাহাড়ের সমস্যা স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তির দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অতি জরুরি।
হ্লামিউ মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠী সেটেলার বাঙালিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে পাহাড়িদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই যে, সেখানে সেনাবাহিনী এক বিশেষ কায়দায় অগণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রেখেছে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, জুম্ম জনগণ এখনো বিশ্বাস করে তারা নিজেদের নায্য অধিকার আদায় করে নিতে সক্ষম।
পাভেল ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অনীহা ও আন্তরিকতা না থাকার কারণে পাহাড়ের মানুষ আজও অনিরাপদ জীবন পার করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী শিশু থেকে যুবতীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারছে না। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান ভূমি সমস্যা যা আদিবাসীদের অস্তিত্বকে ক্রমশ সংকটময় করে তুলছে।
অন্বেষ চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ের মানুষ এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার প্রধান কারণ পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া। আজকে পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে সেটা রাষ্ট্রের বিচারহীনতা সংস্কৃতিরই ফল। অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও দেশে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে তারা আরও অপরাধমূলক কাজ করার সুযোগ পায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের অধিক সময় পেরিয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন দেখতে পাই। এছাড়াও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের ভূমি ও জীবন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের যথাযথ উদ্যোগের দাবি জানান।
স্বাগত বক্তব্যে অম্লান চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়েছে। জুম্মদের নায্য অধিকার না থাকার কারণে তাদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাহাড়ের প্রতিনিয়ত নারীদের শারীরিক লাঞ্ছনা, অত্যাচার প্রতিদিনের ঘটনা। সরকার আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নে গড়িমসি করার কারণে সমতলেও আমরা দেখি আদিবাসীরা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসা উচিত।
সভাপতির বক্তব্যে বিনিময় চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠী ভাগ কর শাসন কর নীতির মাধ্যমে জুম্মদের মধ্যে বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি করছে। যার কারণে পাহাড়ের সমস্যা বরাবরের মতো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার মধ্যে আমরা দেখি, আদিবাসী নারীদের অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তাও সংকটে। এর আগেও দেখেছি, বিলাইছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। নিরাপত্তা বাহিনী পাহাড়ে আমাদের অনিরাপত্তায় ফেলে দিচ্ছে। এর স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি।
সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশটি শেষ হয় এবং এরপর বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি চেরাগী পাহাড় মোড় থেকে শুরু হয় এবং প্রেস ক্লাস ভবন হয়ে আবার চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে শেষ হয়।