হিল ভয়েস, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ঢাকা: আজ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, সকাল ১০টায় ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ও করণীয়” শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন” এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন এর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ জাসদ এর সাংগঠনিক সম্পাদক মুকসেদুর রহমান লাভু এবং জাসদ প্রতিনিধি ও জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা প্রমুখ।
রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের এই যে উদ্যোগে আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য দলগুলোকেও যুক্ত করা যায় কি না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কেননা, আমাদের দেশের বাস্তবতায় বাম-প্রগতিশীল দলগুলোর যে শক্তি-সামর্থ্য সেটা এই আন্দোলনকে সফল করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটি বড় অর্জন। যদিও শেখ হাসিনার শাসনামলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিন্তু এই চুক্তি হওয়ার পেছনে একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। একদিকে যেমন পাহাড়ে লড়াই-সংগ্রাম হয়েছিল অন্যদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমতলেও একটা প্রচেষ্টা ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ কমিটি গড়ে তোলা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান যে সামরিক সমাধানের চেষ্ঠা করেছিলেন তার পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। চুক্তির একটি বড় দিক ছিল বেসামরিকিকরণ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহায় দিয়ে সেখানে এখন উল্টো সামরিকায়ন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সামরিক সমাধান নেই, রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।
বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন যে জাতি সমূহ রয়েছে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখনো নেই। পাহাড় এবং সমতলের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীর সাথে বাসদ সম্পূর্ণ একমত। আজকের মতবিনিময় সভায় উত্থাপিত মূল বক্তব্যে যেসব দাবী পেশ করা হয়েছে তার অধিকাংশ বিষয়াবলীর সাথে বাসদ একমত।
রুহিন হোসেন প্রিন্স উত্থাপিত মূল বক্তব্যের আলোকে তার মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতি কেবল আঞ্চলিক দল হিসেবে নয়, জাতীয় পর্যায়েও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে এবং এক্ষেত্রে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। আদিবাসীদের মধ্যকার ঐক্য-সংহতি জোরদার করার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। ৭২ এর সংবিধানের কিছু অসম্পূর্ণতা থাকলেও সেই সংবিধানের আলোকে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
এস এম এ সবুর বলেন, পাহাড় বা সমতল অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের আজকের যে সমস্যা তার মূল উৎপত্তিস্থল কিন্তু সংবিধান। সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না থাকায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ঔপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত আইন এবং বিধিবিধান অনুযায়ীও পার্বত্য অঞ্চল একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। সেখানে বাইরের কেউ বসতি করতে পারবে না এমন ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আজকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারগুলো সে বিশেষ শাসনব্যবস্থা স্বীকৃতি দিতে পারছে না। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী অধিকার এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গৃহিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা দেখা যায় না।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই তো শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল। এখন, চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যে নতুন করে অস্ত্র হাতে তুলে নেবে না তার নিশ্চয়তা তো দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশ জাসদ এর সাংগঠনিক সম্পাদক মুকসেদুর রহমান লাভু বলেন, বাংলাদেশ জাসদ জন্মলগ্ন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন এবং আদিবাসীদের অধিকার এর প্রশ্নে বরাবরই সোচ্চার ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা জাসদের অন্যতম একটি মূল দাবী। আগামী দিনেও জাসদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসীদের ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাবে।
জাসদ প্রতিনিধি ও জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা বলেন, দীর্ঘ ২০ বছরের অধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে চুক্তি হয়েছে। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এর জন্য আবার আন্দোলন করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে কি আবার পুনরায় যুদ্ধাবস্থা হতে যাচ্ছে? ভাবসাব দেখে তো তাই মনে হয়। সাংবিধানিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি থাকা দরকার। পার্বত্য চুক্তিরও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা দরকার। পাহাড়ের সুর কিন্তু ভাল না। এসময় তিনি প্রশ্ন রাখেন কুকী চীন কারা তৈরী করেছে? কারা প্রশিক্ষণ দেয়? সেখানে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আর জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চুক্তি বিরোধী একটি শক্তি এখনও সক্রিয় রয়েছে। কাজেই সকলের ভালর জন্যই চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়া দরকার।
মেসবাহ কামাল বলেন, বাংলাদেশ বহু জাতির, বহ ধর্মের, বহু সংস্কৃতির দেশ, সেটা ধীরে ধীরে হলেও জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। সরকারি গবেষণায় বাংলাদেশে প্রায় ৪১ টি ভাষার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটা বাংলাদেশের বৈচিত্র এবং বহুত্বকে তুলে ধরে। সংবিধানে ২৩ (খ) তে আদিবাসী জাতিসমূহকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের আশঙ্কা, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সেখানকার অবস্থা চুক্তি পূর্ববর্তী অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে কি না। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেসামরিকীকরণ করার একটা সুযোগ তৈরী হয়েছিল। কিন্তু আজ একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরী হচ্ছে।
এদিকে মূল বক্তব্যে অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের নিকট নিম্নোক্ত সাতদফা দাবিনামা পেশ করেন:
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচী ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে এই চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. পাহাড়ে সামরিক কর্তৃত্ব ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের স্থায়ী অবসান করতে হবে।
৩. আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিকীকরণ ও স্থানীয় শাসন নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক যথাযথ ক্ষমতায়ন করতে হবে।
৪. পার্বত্য ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’কে কার্যকরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করে তাঁদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৫. দেশের মূল স্রোতধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
সমতলের আদিবাসীদের জন্য দাবিসমূহ হলো-
১. ইউনিয়ন পরিষদসহ সকল স্তরের স্থানীয় সরকারে সমতলের আদিবাসীদেও জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ ও আদিবাসী জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসী সম্পর্কিত নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উত্থাপিত ৭ দফা দাবি গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা, উল্লিখিত ৭ দফা দাবিনামার আলোকে স্ব স্ব রাজনৈতিক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করা, রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠন সমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসী জনগণের বিষয়ে একজন মুখপাত্র ও সাংগঠনিকভাবে সম্পাদক পদ তৈরী করাসহ জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহে আদিবাসীদের মনোনয়ন প্রদান করার জন্য বাংলাদেশের সকল বাম-প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বানও জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।