হিল ভয়েস, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: “আপনারা আপনাদের সংগ্রাম করুন। এই সংগ্রামে কিন্তু ভারতকে সামিল হতে হলে পশ্চিম বাংলায় এ সম্বন্ধে চেতনা জাগ্রত করতে হবে।” কলকাতা সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেন ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ বন্ধ কর’- শ্লোগানকে সামনে রেখে ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট অ্যাট্রোসিটিস অন মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ (ক্যাম্ব) ও অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে আজ শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) অপরাহ্ন ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত “মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন” বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ফাইন আর্টস একাডেমিতে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন ক্যাম্ব-এর ড: মোহিত রায় এবং সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের জয়েন্ট কনভেনার সুজিত শিকদার।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখনে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়, বার্ক-এর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. যিষ্ণু বসু, সিএইচটি পিস ক্যাম্পেইন গ্রুপের করুণালংকার ভিক্ষু প্রমুখ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার চক্রবর্তী সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, বাঙালিরা পৃথিবীর সমস্ত জিনিস নিয়ে ভাবে। ভিয়েতনাম, কিউবা, নিকারাগুয়া, গাজা- কত রকম জিনিস নিয়ে আমরা ভাবি! শুধু আমাদের নিকটতম যারা আত্মীয়, অর্থাৎ বাংলাদেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হিন্দু বাঙালি এবং অন্য যারা আছেন, যাদের জন্য আজকের এই সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, অর্থাৎ চাকমা এবং অন্যান্য জনজাতি রয়েছেন, এদের সম্পর্কে আমরা কম জানি। কিউবা থেকে আরম্ভ করে এত দেশের লোকেদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চিন্তায় ঘুম নেই, চুলচেরা বিশ্লেষণ, অথচ তাদের নিকটতম আত্মীয়- এদের সম্পর্কে কোনো চিন্তাই নেই।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। আমি সাধারণভাবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং অবিভক্ত বাংলা, এর আগে ব্রিটিশ বিদায় নেবার আগে অবিভক্ত বাংলার যে লাইন মার্কস আছে, সেই লাইন মার্কসের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, অর্থাৎ হিন্দু এবং তার সঙ্গে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- এদের সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। মূল বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, আপনারা অতীত ভুলবেন না, আপনারা যদি অতীত ভুলে যান তাহলে আপনারা আবার সেই যন্ত্রণা ভোগ করবেন।
সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে সরকার অতি সুক্ষ্ম কৌশলে রোহিঙ্গাসহ সমতল জেলাগুলো থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী বসতি প্রদান করে চলেছে। মুসলিম সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের পরিবর্তে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলে মদদ দেয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে এখনো সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২৬ বছরেও এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসন ব্যবস্থা এখনো যথাযথভাবে গড়ে উঠেনি।
শ্রী তালুকদার আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ তথা অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে সুরক্ষা দিতে হলে জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রামে টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে জনমত গঠন করা ও সারাবিশ্বে প্রচার ও জনমত গঠনের কাজ জোরদার করা এবং জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাব রাখেন।
ঢাবি শিক্ষক ড: মেসবাহ কামাল বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বর্তমান সরকার। আজ তারা ক্ষমতায়, কিন্তু ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ৯২,৫০০ পরিবার মানুষ তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীদের সংগ্রামও অত্যন্ত ন্যায্য সংগ্রাম। কারণ বাঙালিদের সংগ্রাম যদি ন্যায্য হয়ে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামও ন্যায্য। বাঙালি তার ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিল যুদ্ধ করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণেরও তার আত্মপরিচয়ের অধিকার ন্যায্য অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে বলেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা চেয়েছিল সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে একটু জায়াগা দেওয়া। বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে দেশের জনগণ সবাই বাঙালি। এমনকি বাংলাদেশের মধ্যে বসবাসরত ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে নাম দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বাংলাদেশ সরকার সমতল থেকে ৫ লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করাতে লাগল। সেই বাঙালিদের দিয়ে স্থানীয় পাহাড়িদের উপর হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং জমি দখল করতে লাগল। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ কী করবে, জীবন বাঁচানোর জন্য তখন সেদিন প্রতিরোধে নেমেছে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ, নিজের আত্মপরিচয়কে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ ন্যায়সঙ্গত। যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত।
ড. যিষ্ণু বসু বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সত্যিই তার স্বকীয়তা হারায়, তার মানে এটা ইসলামী মৌলবাদের আখড়ায় পরিণত হবে। তাহলে এই উপমহাদেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে। ভারতবর্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অরুণাচলে এবং অন্যান্য জায়গাতে যারা এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একটা মানুষ তার জাতির প্রতি অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ কখনোই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না বলেই তারা প্রতিবাদ করে, আন্দোলন করে।
তিনি আরো বলেন, আজকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন মনের ভেতরে ভয় কাজ করে। এতক্ষণ পর্যন্ত ঊষাতন বাবু তার বক্তব্যে তাদের মা-বোনদের উপর নিদারুন অত্যাচারের কথা বলেছেন তা ভাষায় বলার নয়। আমার জানা মতে ইংরেজ শাসনামল থেকে তাদের খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তর করার চেষ্টা করা হলেও তাদের খুব কম সংখ্যক লোককে ধর্মান্তর করা সম্ভব হয়েছে। কতটা নিজের জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সংস্কৃতি মনের গভীরে গ্রোথিত রয়েছে, ভালবাসা রয়েছে সেটা তা বোঝা যায়। বাংলা বাংলাভাষি মানুষ যদি মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চুক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তাহলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেই বিষয়ে সমর্থন প্রকাশ করা প্রয়োজন। রাস্তায় নেমে আমাদের সংগঠিতভাবে এই কথা বলতে হবে, সেই দিন আজকে এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি কমিশন কাজ করার জন্য যে বিধিমালাটা দরকার, এখনো পর্যন্ত সেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ আটকে আছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য টাস্ক ফোর্স করা হয়েছে। ১২ হাজার পরিবার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং ৯০ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু রয়েছেন। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার পরিবারের মধ্যে ৯ হাজার পরিবারকে তাদের ভূমি ফেরত দেয়া হয়নি। ৯০ হাজার পরিবারের কাউকে এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি, কোন রেশনও দেয়া হচ্ছে না। অথচ সামরিক শাসনামলে আমাদেরকে ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু করার জন্য বাইরে থেকে যে বাঙালি মুসলমানদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছে তাদেরকে এখনো পর্যন্ত রেশন দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন তো হচ্ছেই না, বরং সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পর্যটনের নামে জুম্মদের ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সীমান্ত সড়ক দিয়ে জুম্মদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
নির্ধারিত আলোচকদের আলোচনা শেষে সাংবাদিক ও অংশগ্রহণকারী অনেকে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এসময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে গৌতম দেওয়ান ও মেসবাহ কামাল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। সম্মেলনে প্রায় ১৫০ জনের মতো লোক অংশগ্রহণ করেছেন বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে।