হিল ভয়েস, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) উদ্যোগে জুম্ম শিক্ষার্থীদের নিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় ২৯৯ নং পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, তরুণদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে, সাহসী ভুমিকা পালন করতে হবে।
গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে পিসিপি’র ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে “জুম তরুণের শেকড়ের প্রাণ, চেতনার আকুতিতে দাও শাণ” আহ্বান নিয়ে ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক, নার্সিং-এ ভর্তি হওয়া ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ সেশনের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উক্ত নবীণবরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পিসিপি’র ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি রেং ইয়ং ম্রোর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ২৯৯ নং পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সাংসদ ও জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। এতে আরও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মিহির লাল সাহা, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ঈষাণী চক্রবর্তী, পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যোতিষী চাকমা এবং পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার ও কালচারাল সোসাইটির সদস্যদের মাধ্যমে জাতীয় সংগীত ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দলীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু হয় ।
নবীনদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষে শিক্ষার্থী অর্পা খীসা।
এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র ঢাকা মহানগর শাখার সহ-সভাপতি সতেজ চাকমা। নবীনদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ সেশনের ক্রইনুচিং মারমা এবং ২০২২-২৩ সেশনের নেবাই খুমী সামথাং।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঊষাতন তালুকদার বলেন, পাহাড়ের মানুষের জীবনের অনিরাপত্তা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সহ নানান কঠিন বাস্তবতায় আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তরুণদের নিজ নিজ যোগ্যতা অর্জন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সমাজ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। তরুণদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে, সাহসী ভুমিকা পালন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কোনোকিছুই রাজনীতির বাইরে নয়, তাই আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান রাখতে হবে, রাজনৈতিক সচেতন হতে হবে এবং বিশ্বের নানান ঘটনাবলির খোঁজ রেখে চলতে হবে।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ড. সাদেকা হালিম পার্বত্য চুক্তির কথা উল্লেখ করেন এবং পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের দেয়া নানান সুযোগের সদ্ব্যবহারের কথা বলেন। তিনি বলেন, “প্রত্যেক মানুষের তাঁর নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে এবং আদিবাসীরা যেন তাঁদের নিজ নিজ আত্মপরিচয় মাথা উঁচু করে দেয় সেই মানসিকতা থাকতে হবে। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একাডেমিকের পাশাপাশি বন, ভুমি, সিডঅ বিষয়ক আইন জানতে হবে, রাজনৈতিক সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিজেদের সলিডারিটি বাড়াতে হবে। অধিকতর পিছিয়ে পড়া ম্রো, খিয়াং, বম, চাক, লুসাইদের সুযোগ দিতে হবে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. মিহির লাল সাহা নিজেকে জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের পরিচয় দিয়ে তিনি প্রিয় শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে সর্বদা পাশে থাকবেন এবং নবনির্মিত রবীন্দ্র ভবনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সিট বরাদ্দের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে অধ্যয়ন করে সুন্দর ফুল হওয়ার কথা বলেন। তিনি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকার মানসিকতা রেখে এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন।
ড. ঈষাণী চক্রবর্তী নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে, এ সময়টা তোমাদের সারাজীবন মনে থাকবে। আমরাও খুব খুশী তোমাদের স্মৃতির অংশীদার হলাম। শত বাধা পেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। এ যাত্রায় মিশ্র অনুভুতি থাকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে থাকে ভয়, চ্যালেঞ্জ, নতুন অভিজ্ঞতা। সেগুলো শঙ্কা তৈরি করলেও অপার আনন্দও বটে। আনন্দ হলো স্বাধীনতা। পরিবারের নানান শৃঙ্খলা পেরিয়ে নিজের মত চলা, একলা চলার জন্য প্রস্তুতির সময় এ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এখানে অপার স্বাধীনতা আছে। নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। টেকনলজির জ্ঞান রাখতে হবে এবং বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার-এ যুক্ত থাকার চেষ্টা করবে। প্রতিষ্ঠান যে সুযোগ দিবে সেগুলো কাজে লাগাবে। স্বপ্ন দেখো। চোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা আকাঙ্খা। তবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজ নিজ জাতিদের জন্য অবশ্যই ভাবতে হবে, নিজেদের দায়িত্ববোধ যেন ভুলে না যাও।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে পালি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জ্যোতিষী চাকমা বলেন, “পাহাড়ের তরুণদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভালো মানুষ হতে হবে, স্মার্ট হতে হবে। স্মার্টনেস মানে পোশাকের স্মার্টনেস নয়, বরং বাস্তব জীবনে যে যত বেশি সমস্যা সমাধান করতে পারবে ততবেশি স্মার্ট। এজন্য পাহাড়ের বাস্তবতায় আমাদের চিন্তা, মনন ও কাজে পাহাড়ী তরুণ সমাজকে স্মার্ট হতে হবে এবং নিজের চিন্তায় শুধু মগ্ন না থেকে অপরকে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা ৫ দশকের অধিক সামরিক শাসন এবং শত বাধা-বিপত্তি ও বঞ্চনা পেরিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান এবং এম এন লারমার উক্তি ‘শিক্ষিত হও, গ্রামে ফিরে চলো’র মতো পাহাড়ের তরুণ সমাজকে শিক্ষিত হয়ে শেকড়ের জন্য এগিয়ে আসার আহবান জানান।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের তরুণদের শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটিয়ে অন্যায়, অবিচার, শোষণ-নিপীড়ন ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, কাজ করতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মত পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জুম্ম শিক্ষার্থী সমাজকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি ড. সাদেকা হালিমের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রমে একদম পিছিয়ে থাকা ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া, বম আদিবাসীদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি রাখার অনুরোধ জানান এবং পাহাড়ের তরুণ সমাজকে নিজেদের শেকড়কে না ভুলে দেশ ও জাতির কল্যাণে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে রেং ইয়ং ম্রো বলেন, “পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার লাভের একটা অংশ পার্বত্য চুক্তি।” তিনি নবীনদের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসা এবং শিক্ষিত হয়ে পাহাড়ের শেকড়ের প্রতি তরুণ সমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার আহবান জানান। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে সংগ্রাম করতে হবে।
নির্ধারিত বক্তব্যের পর ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ সেশনের নবীন জুম্ম শিক্ষার্থীদের ক্রেস্ট ও ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।
এরপর সাংস্কৃতিক পর্বে মাস্টার্সে শিক্ষার্থী ঐতিহ্য চাকমা ও ৪র্থ বর্ষের জয়া চাকমার সঞ্চালনায় সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয় নবীন শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার ও কালচারাল সোসাইটির সদস্যবৃন্দ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত হয় এবং প্রায় ৫০০ শতাধিক শিক্ষার্থী এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন।