হিল ভয়েস, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ঢাকা: আজ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ঢাকা মহানগর শাখা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডাব্লিউএফ), ঢাকা মহানগর কমিটির উদ্যোগে শিক্ষা দিবস উপলক্ষে দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% শিক্ষা কোটা চালু করা সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
পিসিপি, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর শাখার সহ-সভাপতি শুভ চাকমা। ছাত্র সমাবেশে সংহতি জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি দীপক শীল, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান নীরব, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মৌসুমী চাকমা ও বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মংক্যজাই চাক।
সমাবেশের স্বাগত বক্তব্যে পিসিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মংক্যজাই চাক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র লোক দেখানো উন্নয়ন ছাড়াও যেসকল অধিকার ও উন্নয়নগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষের দরকার তা করা হচ্ছে না। সেখানে ভালো মানের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। যার ফলে কয়েকজন ছাড়া উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারছে না। সেখানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করা হচ্ছে এবং ৫% শিক্ষা কোটা না থাকায় প্রত্যেক বছর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেও অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজসমূহে শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট এবং আবাসন সংকটের কারণে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও সেখানে শুধু প্রাথমিক শিক্ষাকে ত্রুটিপূর্ণভাবে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। জেলা পরিষদগুলো লাখ লাখ টাকার দূর্নীতির মাধ্যমে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে চলছে। যেসব শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশ নিজ বিদ্যালয়ে কর্মস্থলে না দিয়ে ভাড়াটিয়া শিক্ষকের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করে থাকে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা লাভ করতে পারছে না।’
প্রথম আলো পত্রিকার তথ্যকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পন্ন করার পর ৪০% আদিবাসী শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে যায় শুধুমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চরম সংকটের কারণে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেমন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংকট রয়েছে, ঠিক তেমনি সেখানে দক্ষ শিক্ষক সংকট, আবাসন সংকটের কারণেও আদিবাসী শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কলেজগুলোর অবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। দক্ষ শিক্ষকের অভাব, আবাসনের সংকটের কারণে পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা লাভ করা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। ফলে তারা সমতলের বাঙালিদের সাথে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এজন্যই পিছিয়ে পড়া ৫০টির অধিক আদিবাসী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিশ্চিত করতে আদিবাসীদের জন্য ৫% শিক্ষা কোটা চালু করা প্রয়োজন।’
রুমেন চাকমা আরো বলেন ‘প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এমন বেহাল দশায় রেখে সরকার সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণ কোনোভাবেই আদিবাসী বান্ধব উন্নয়ন হতে পারে না। বরং সেটি পার্বত্যাঞ্চলে শিক্ষিত বাঙালি পুনর্বাসনের প্রকল্প।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি দীপক শীল বলেন, ‘৬১ বছর আগে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে যে বিষয় নিয়ে আন্দোলন করা হয়, ৬১ বছর পরে সেই একই বিষয়ে আমাদের দাবি জানাতে হচ্ছে এর থেকে লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আজকে এই প্রশাসনের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষাকে কিনতে হচ্ছে। যার মাধ্যমে ৬২তে যারা শিক্ষা আন্দোলন করেছিলেন এবং প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের সাথে বেঈমানী করা হচ্ছে। আমাদের আজ শুনতে হয় আদিবাসীদেরকে ‘আদিবাসী’ বলা যাবে না। কিন্তু ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে এই আওয়ামীলীগ সরকারের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসীদের ’আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা উন্নয়নের আগে মৌলিক অধিকারগুলো পেতে চাই।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ বলেন, ‘প্রত্যেক বছর শিক্ষা খাতে বাজেট কমানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে ভালো মানের কোনো স্কুল ও কলেজ নেই, সেখানে মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক নেই। তিনি আরও আদিবাসীদের জন্য আলাদা শিক্ষা বাজেট করা ও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার দাবি জানান।’
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান নুর নীরব বলেন, ‘অন্যান্য মৌলিক অধিকারসহ শিক্ষার অধিকারে বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মানুষদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে বৈষম্য করা হচ্ছে। তিনটি পার্বত্য জেলাকে বাদ দিয়ে আমাদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সকল জায়গায় সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা সহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করার আহবান জানান।’
হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মৌসুমী চাকমা লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। শিক্ষা সবার জন্য। জনগণকে শিক্ষিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়িরা শিক্ষার অধিকার ও সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। যার কারণে তারা উচ্চ শিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না।’ তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োজনের বেশি মসজিদ, মন্দির নির্মাণ করা হয় কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঘাটতি থেকেই যায়। সাজেকসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদ, বিহার নির্মাণ করা হয় কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি ভালো হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় না। এছাড়া তিনি বলেন, অসৎ ও দূর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক, সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের শাস্তির জোন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যবহার করা হয়। যার ফলে তাদের কাজের মধ্যে অসততা, দূর্নীতি দেখা দেয় এবং আন্তরিকতার অভাব দেখা যায়।’
ছাত্র সমাবেশের সভাপতি শুভ চাকমা উত্থাপিত দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিকট জোরালো দাবি জানান।