অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল
[গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ বন্ধ কর’ শ্লোগানকে সামনে রেখে ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট অ্যাট্রোসিটিস অন মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ (ক্যাম্ব) ও অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে ‘মানবাধিকার লংঘন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন’ বিষয়ে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে প্যানেল আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। তাঁর সম্পূর্ণ বক্তব্যটি এখানে প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করা হলো।]
আমি প্রথমেই ঢাকায় গতকাল থেকে শুরু হয়ে আজকে যে সমাবেশ চলছে তার সাথে সংহতি ঘোষণা করছি, ঢাকায় থাকলে আমিও সেখানে থাকতাম। আর আজকে এখানে যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন, তার সাথেও সংহতি প্রকাশ করছি।
আমি প্রথমেই বলি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শরণার্থী আসা শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে। কিন্তু তখন ততটা হয়নি, প্রধানত হয়েছে যখন কাপ্তাই বাঁধ তৈরি হলো। সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে আবাদযোগ্য ভূমি তার ৪০ শতাংশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। আটটা উপজেলা বলি আমরা, আপনাদের আটটা ব্লকের সমান জায়গা পানির নীচে তলিয়ে গেছে, রাজার বাড়িও পানির নীচে তলিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে এক লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ওখান থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে, সে বিদ্যুতের এক কণা পরিমাণও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ভোগ করতে পারেনি। যে এক লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেন, সেই এক লক্ষ মানুষের মধ্য থেকে ৪০ হাজার মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে এসেছেন। সেটা হচ্ছে ষাটের দশকের গোড়ার কথা। ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪- এই সময়ের কথা।
সেই মানুষগুলো যারা দেশ ত্যাগ করেছেন, তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের দু-তিনটা রাজ্য ঘুরতে ঘুরতে, পায়ে হেঁটে, অনেকে শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছেন অরুণাচল রাজ্যে। এবং আপনারা যদি ১৯৬১-৬৪ থেকে হিসাব করেন, তাহলে আজকে কত বছর, প্রায় ৭০ বছর, এত বছর পরেও সেই মানুষগুলো এখনো ভারতের নাগরিকত্ব পাননি। আসার পথে তারা অনেকেই মারা গেছেন এবং এখানে এসে তারা আশ্রয় পেয়েছেন, কিন্তু তারা স্টেটলেস সিটিজেন (রাষ্ট্রহীন নাগরিক)। সেই ৪০ হাজার মানুষের সংখ্যা এখন এক লক্ষের বেশি হয়ে গেছে। মানুষ কী দুর্ভোগে রয়েছেন!
কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, এরা তো বাংলাদেশের মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের কথা ভুলে গেছে। যেমন এই ঘরে আপনারা অনেকেই আছেন, যারা বাংলাদেশের মানুষ, যারা সাম্প্রদায়িক দেশ বিভাগের কারণে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে এদেশে এসেছেন। যে মাটিতে আপনাদের নাড়ি পোতা, সেই মাটি ছেড়ে এসেছেন। আপনাদের কথাও বাংলাদেশ ভুলে গেছে। আমি খুব কষ্টের সাথে কথাগুলো বলছি। কারণ ‘দেশভাগ’ বাংলাদেশে কোনো আলোচ্য বিষয় নয়। এমনকি যে একাডেমিক চর্চা হয়, সেই একাডেমিক চর্চাতেও ‘পার্টিশান’ আলোচ্য বিষয় নয়। এমনকি কবিতা, গল্প, সাহিত্যের মধ্যেও খুবই সামান্য তার রিফ্লেকশান। কিছু আছে, যারা এদেশ থেকে বাংলাদেশে গেছেন, যেমন হাসান আজিজুল হক কিংবা আনিসুজ্জান, তাঁদের লেখায় কিছু পাবেন। এছাড়া তেমন কোনো রিফ্লেকশান আমরা সাহিত্যেও পাই না।
এই যে দুর্ভাগ্য, এই যে নাড়িছেঁড়া মানুষগুলো আসেন এখানে, এবং ওখানে শুধু চাকমারা না, তার আগে ময়মনসিংহে, ওখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গভর্ণর ছিলেন মোনায়েম খান, মোনায়েম খানের নিজের জেলা ময়মনসিংহ, এই ময়মনসিংহেরই সীমান্তবর্তী গারো, হাজং- এনারা থাকেন, সেইখানে একেবারে মুসলিমলীগের গুন্ডা, তার সাথে সেনাবাহিনী নামিয়ে সেখান থেকে হাজংদেরকে এবং গারোদেরকে উৎখাত করা হয়েছিল। হাজংরা ছিলেন হিন্দু, গারোরা ছিলেন খ্রিশ্চিয়ান বেশির ভাগ। সেই গারো খ্রিশ্চিয়ানরা দেশান্তরিত হওয়ার পরে আন্তর্জাতিকভাবে খ্রিশ্চিয়ানরা সংগঠিত হয়েছিল। পরে পাকিস্তান সরকার ওদেরকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করে। বর্ডারের কাছে মাইক লাগিয়ে আহ্বান করা হয়, আপনারা আসুন বলে। হাজংরা হিন্দু ছিলেন, তারা ফিরতে পারেননি এবং ওখান থেকে মেঘালয়ের তুরা, ওখান থেকে যেয়ে তারা অরুণাচলে আশ্রয় নিলেন। তারাও এখনো নাগরিকত্ব পাননি। এই হচ্ছে এই রিফিউজিদের অবস্থা।
বাংলাদেশ থেকে তারপরেও আবার রিফিউজি এসেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন সংঘাত শুরু হয়েছে। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চাপে সেখান থেকে প্রায় এক লক্ষ মানুষ এখানে ভারতে এসেছে রিফিউজি হিসেবে। মূলত চাকমা এবং অন্যান্য জাতির মানুষ। এবং তাদের মধ্য থেকে ৬৫ হাজার মানুষ ফিরে গেছে। বাকীরা ফিরে যেতে পারেননি। কিন্তু যে ৬৫ হাজার ফিরে গেছেন, সেই ৬৫ হাজার মানুষকে কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে, লিখিত চুক্তি মোতাবেক তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে পুনর্বাসন করার কথা ছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে গৌতম দা বললেন, ঊষাতন দাও সেটা একটু ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে, এই ৬৫ হাজার মানুষ তাদের নিজের বাড়িঘরে জায়গা-জমিতে ফিরে যেতে পারেননি। এটাতো একটি দিক।
আরেকটা দিক হচ্ছে, এই যে যুদ্ধের ২০ বছর, এই ২০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতরে যে আদিবাসীরা ছিলেন, এই আদিবাসীদের মধ্যে অনেক মানুষ যারা ছিলেন তারা তো নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। যেমন এক কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে এসেছিলেন, ভারত সরকার জায়গা দিয়েছিলেন, তেমনি আবার প্রায় ৪ কোটি মানুষ দেশের ভেতরে উদ্বাস্তু ছিলেন। আমি নিজে একজন উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য ছিলাম। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় এক লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু দেশের ভেতরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ছিলেন। সেই উদ্বাস্তুরা, তারাও কিন্তু পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী নিজের জমিতে, নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা। সেটার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেটা কিন্তু রাষ্ট্র করেনি।
পার্বত্য চুক্তি করেছে এই সরকার, সেই সরকার এখনো ক্ষমতায় আছে, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর চুক্তি হয়েছে, ২৫ বছর পার হয়ে গেছে, ওই মানুষগুলো এখনো নিজের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারেনি। তাদের সংখ্যা ৯২,৫০০+ পরিবার। বাংলাদেশে একটা পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৫.৫। তাহলে ৯২,৫০০-কে ৫.৫ দিয়ে গুণ করে দেখেন, কত মানুষ হয়। আর তার সাথে শরণার্থী যারা ফিরে এসেছেন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ তো তাদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারেননি। এই যদি হয় বাস্তবতা, চুক্তি করার ২৫ বছর পরে, তারপরে মানুষের জীবনে আর কী বাকী থাকে!
এই কথাগুলো বলছি, আমার নাম শুনে বুঝেছেন আমি একজন বাঙালি এবং বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত। বাঙালি জাতি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম জাতি। বাঙালি হিসেবে আমি খুবই গর্বিত। কিন্তু আমি মনেকরি, বাঙালির যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, ন্যায্য অধিকার আছে, পাকিস্তানীরা সেই অধিকার লংঘন করেছিল বলেই বাংলাদেশের বাঙালি সেদিন যুদ্ধে নেমেছে এবং পাকিস্তানের মত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছে এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার বাঙালিসহ ভারতের সমস্ত জাতির মানুষ আমাদেরকে সমর্থন করেছে।
কিন্তু যেভাবে আমাদের সংগ্রাম ন্যায্য ছিলো, আমি মনেকরি, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমী, খিয়াং, বম সহ যে জাতিগুলো বাস করে তাদের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামও অত্যন্ত ন্যায্য সংগ্রাম। কারণ আমাদের বাঙালিদের সংগ্রাম যদি ন্যায্য হয়ে থাকে, যে কারণে ন্যায্য, কারণ আমরা আমাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছি, আমরা আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা চেয়েছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষও তার পরিচয়ের স্বীকৃতি চায়, তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা চায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অধিকারের সংগ্রামও অত্যন্ত ন্যায্য সংগ্রাম। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদেরকে বলেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী। একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। আমি নিজে এটা নিয়ে গবেষণা করেছি। আমি আমার পিএইচডি করেছি এটা নিয়ে। আমি সমস্ত ডকুমেন্ট পড়ার চেষ্টা করেছি এবং সেনাবাহিনীর কাছে যে ডকুমেন্ট আছে সেগুলোও সার্চ করার চেষ্টা করেছি। আমার বন্ধুরা সেনাবাহিনীতে আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা কী চেয়েছে? তারা চেয়েছে যে, সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে একটু জায়গা দেয়া হোক। যখন বাংলাদেশের সংবিধানও, খুবই দুর্ভাগ্যজনক, যখন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সময়ে যে সংবিধান গ্রহণ করা হলো, সেই সংবিধানেও তাদেরকে জায়গা দেওয়া হলো না। বলা হয়েছে, এদেশের জনগণ জাতিতে বাঙালি। সবাই বাঙালি? তাহলে ঊষাতন তালুকদার বসে আছেন, উনিও কি বাঙালি? বাংলাদেশ এখন কিন্তু ৫০টা আদিবাসী জাতিকে, আদিবাসী নামে নয়, অন্য নামে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নামে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার মানে, বাঙালি ছাড়াও আরও ৫০টা জাতি আছে। এই ৫০টা জাতিকে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেই জাতিগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য যে কমিটি করেছিলো, সেই কমিটির প্রধান ছিলাম আমি। আমি এবং আমার টিম ৭৮টা জাতিকে চিহ্নিত করেছি। তার থেকে বাংলাদেশ সরকার ৫০টা জাতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার মানে, যে স্বীকৃতিটা তারা ৫২ বছর পরে এসে দিলো বা ৫০ বছর পরে এসে দিলো, সেই স্বীকৃতিটা যদি ৭২-এ দেয়া হতো, তাহলে তো যুদ্ধের দরকার হতো না। এবং সরকার কী করেছে? সমতল থেকে ৪ থেকে ৫ লক্ষ বাঙালি মুসলমানকে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসিয়ে দিলো এবং সেখানে তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর ছত্রছায়ায় অন্যদের উপর হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, জমিজমা দখল করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তারা কী করবে? জীবন বাঁচানোর জন্য তারা সেদিন প্রতিরোধে নেমেছে এবং নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ, নিজের আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য প্রতিরোধ ন্যায়সঙ্গত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত। এটা রাষ্ট্রীয় পলিসির ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় পলিসি যদি ডাইভারসিটিকে স্বীকার করে, রাষ্ট্র যদি প্লুরালিটিকে স্বীকার করে, তারা যদি বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে, এদেশে একটা জাতির মানুষ না, এদেশে বহু জাতির মানুষ আছে, একটা ধর্মের মানুষ না বহু ধর্মের মানুষ আছে, যেমন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আরও অন্যান্য মানুষ আছে, বাঙালির পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমী, খিয়াং, সাঁওতাল, ওঁরাও, গারো, মনিপুরী, কত জাতি আছে, এই সকলের স্বীকৃতিটা যদি সংবিধান দেয়, তাহলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বন্ধুরা, তারা চেয়েছেন, সংবিধানের মধ্যে একটু জায়গা দিন। তারা বলেছে আমাদেরকে একটু আশ্রয় দিন। তারা কী চান? তারা চান, সংবিধানে দুই ধরনের অন্তর্ভুক্তি। একটা অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে, বাঙালি ছাড়াও এদেশে আরো অনেক জাতি আছে- এই কথাটা লেখা হোক এবং তার একটা তালিকা, একটা সিডিউল, আপনাদের যেমন আছে এসটি সিডিউল, তারা চান এরকম একটা সিডিউল করে সবাইকে যুক্ত করে নেওয়া হোক। এই সিডিউল তো ছিলো। এমনকি পাকিস্তানের ৫৬ সালের সংবিধানেও এই সিডিউল ছিলো। সেই সিডিউল ভারতের সংবিধানে তুলে ধরা হয়েছে। আপনাদের এখানে এসটি আছে, এসসি আছে, ওযিসি আছে।
বাংলাদেশে কিছুই নাই। সেখানে কোনো এসটি নাই, এসসি নাই, ওযিসি নাই, তো বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ তাদের কি নাগরিক অধিকার নাই? তাদের কি সমান তালে এগিয়ে আসার সুযোগ থাকা উচিত নয়? তাদের জন্য কি বিশেষ ব্যবস্থার দরকার নাই? তাদের জন্য কোটার দরকার নাই স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে, চাকরিতে? নিশ্চয়ই দরকার আছে। কারণ পিছিয়ে যারা পড়ে আছে তাদেরকে সমানতালে এগিয়ে আসার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্র যদি এগুলো না করে, রাষ্ট্র যদি ডাইভারসিটি, প্লুরালিটিকে ডিনাই করে, তাহলে সেখানে মানুষের যে সমঅধিকার, সেই সমঅধিকার লংঘিত হয়। এদিক থেকে আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, এটা শুধু জাতিগত কর্তৃত্ব না, তার সাথে যে অভিযোগটা উঠেছে, খুবই সত্য অভিযোগ, সেখানে আসলে ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যারা এক সময় অসাম্প্রদায়িকতার সংগ্রাম করে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িকতা বিকাশে কাজ করেছেন তারাই আজকে দেখা যাচ্ছে যে, তারাই আজ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের পৃষ্টপোষকতা করছেন। বাংলাদেশ কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার পথে এগুলে সামনে এগুতে পারবে না। ভারতের জন্যও বিপদের কথা বলছি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দখলে চলে যায় তাহলে যেটা হবে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে অশান্তি ছিলো ভারতে, সেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অশান্তিকে উস্কে দেয়ার মত পরিস্থিতি আবার তৈরি হবে। এই বিষয়টা আমার মনে হয় বিবেচনায় আনা উচিত। কাজেই আমি মনে করি, আসলে ভারত-বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য চিরজীবী হওয়া দরকার এবং আপনারা, বিশেষ করে যাদের পূর্বপুরুষের নাড়ি বাংলাদেশে পোতা এবং এদেশের মানুষ যেখানেই জন্ম হোক, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাদের আমাদের পাশে, বিপদের দিনে আপনারা যেমন আগে এসে দাঁড়িয়েছেন, এখনো এসে দাঁড়াবেন।
বাংলাদেশ থেকে কিন্তু বহু মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, শুধু ভারতে আসছেন না, সারা পৃথিবীতে যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন? শুধু কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন না, প্রধানত যেজন্য সংঘ্যালঘুরা যাচ্ছেন, সেটা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। এটা বুঝতে হবে। দেশের খারাপ কথা বলতে ভালো লাগে না, কষ্টবোধ হয়। কিন্তু আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই স্বপ্নের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে দেখতে চাই।