সুলভ চাকমা
ধরা হয়ে থাকে যে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দেশের মোট ভূ-ভাগের এক-দশমাংশ। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র বরাবরই দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে। শত শত বছর ধরে সারি সারি পাহাড়ের ভাঁজ চিরে এখানকার চেঙে, মেঈনী, কাজলং, কর্ণফুলী, রেইংখ্যং, সাংগু, মাতামুহুরীসহ বহু নদীর কলতান চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল হয়ে বঙ্গোপসাগরে যেয়ে মিশেছে।
একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একমাত্র চিরহরিৎ বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত থাকলেও পাহাড়ের গহীন চিরসবুজ বন এখন আর আগেকার মতন নেই। গত কয়েক দশকে পার্বত্য এলাকার ভূ-প্রকৃতি এবং জনমিতিগত বৈশিষ্ঠ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পার্বত্য তিন জেলায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বর্ষায় অতিবৃষ্টি এবং গ্রীষ্মে চরম বিরূপ ভাব যেন এই অঞ্চলের আবহাওয়ার বৈশিষ্ঠ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য জেলাগুলোতে কখনো বন্যা আবার কখনো পাহাড়ধস যেন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাড়িয়েছে।
পাহাড়ি অঞ্চলে একসময় এত ব্যাপক বন্যার কথা কল্পনারও বাইরে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ বন্যায় হাজারো মানুষের দুর্ভোগ, রাস্তাঘাট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়, অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে আমাদের বাধ্য করছে।
গত ২ থেকে ৮ আগস্ট টানা কয়েকদিন ভারি বর্ষণে বান্দরবান শহর সহ সেখানকার অধিকাংশ উপজেলা সদর ছিল প্লাবিত। স্থানীয়দের মতে, বিগত সময়ে এমন ভয়াভহ বন্যা পরিস্থিতি কখনোই দেখা যায় নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৫৬৯টি ঘর ও ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রথম আলো, ১৪ই আগস্ট, ২০২৩)। বেশ কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল সমগ্র বান্দরবান জেলা। টানা বেশ কয়েকদিন ধরে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সাংগু এবং মাতামুহুরী নদী। ভারি বর্ষণ এবং বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দরবানের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এলজিইডির নির্মাণ করা প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ রাস্তা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে (বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ আগস্ট)। হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস সহ সরকারি-বেসরকারি জরুরি পরিসেবা প্রদানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যত অচল অবস্থায় পড়ে ছিল। বান্দরবান সরকারি গণগ্রন্থাগারের প্রায় ২৮ হাজার বই নষ্ট হয়ে গেছে। টানা সপ্তাহখানেক ধরে সমগ্র বান্দরবান দেশের অন্যান্য জেলাগুলো থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। এখনো পর্যন্ত বান্দরবান-রুমা, বান্দরবান-থানচি, থানচি-আলীকদম সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয় নি। পরিস্থিতির উন্নতি হতে বেশ সময় লাগবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কেবল বান্দরবান নয়, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ির অনেক এলাকায়ও বন্যার খবর পাওয়া গেছে যা কিছুকাল আগেও এর নজির ছিল বিরল। দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি সহ অনেক উপজেলায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ব্যাপক পাহাড়ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। সেই দু:সহ স্মৃতি কয়েক বছর পেরিয়ে যেতে না যেতেই পাহাড়ি জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি পাহাড়ি অঞ্চলের সামগ্রিক ভারসাম্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। যদিওবা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই নজিরবিহীন ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল পার্বত্য জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক বিপর্যয়কর বন্যা পরিস্থিতির মূল কারণ বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এমন বিরূপ অবস্থার জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়নসহ আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
সমগ্র পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে গত কয়েক দশক ধরে রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে ব্যাপকভাবে পাহাড় ধ্বংস এবং বন উজার করা হয়েছে। নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানকার মানুষের মৌলিক প্রয়োজন এবং মতামতের তোয়াক্কা না করে জোর করে নির্মল প্রকৃতির উপর উন্নয়নের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শই উঠে আসে কীভাবে একের পর এক পাহাড়ি বনাঞ্চল বিরান হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর পানি প্রবাহে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পাথর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু স্থানীয় ভুক্তভোগী এবং পরিবেশকর্মীদের বারংবার আপত্তি সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরেই বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ি ছড়া, ঝিড়ি, খাল এবং নদী সমূহ থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এইসব ছড়া, ঝিড়ি গুলোই স্থানীয় পাহাড়িদের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস। খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আলীকদম, থানচি, নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রায়শই ডাইরিয়ার প্রকোপ এবং চিকিৎসার অভাবে শিশু মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে।
পার্বত্য এলাকায় রাবার চাষ, তামাক চাষ, অসংখ্য ইটভাটা সেখানকার পরিবেশের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেসব দেখার জন্য যেন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। তার উপরে আমরা শুনতে পাই সেখানে পাঁচতারকা হোটেল বসিয়ে পর্যটন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। অথচ, সাজেকসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে সেখানকার স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর নয়। উপরন্তু, এসকল পর্যটন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোর কারণে স্থানীয় বহু পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। সেখানকার পরিবেশ দূষণের হার বেড়েছে। ভূ-প্রকৃতিগত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি উজাড় করে কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, বান্দরবান সহ পার্বত্য জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর সেকথাই যেন আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে। প্রকৃতির এমন বিরূপ রূপ আমাদেরকে এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, প্রাণ-প্রকৃতি উজার করার আগে তার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের অধিকতর সচেতন হতে হবে। সমগ্র পৃথিবী আজ বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে এখনই সচেতন হওয়া না গেলে আগামী দিনে হয়তো এর চেয়েও ভয়ঙ্কর বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেকারণে আমাদের অবশ্যই পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয় এমন কার্যকলাপের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।