হিল ভয়েস, ১২ আগস্ট ২০২৩, ঢাকা: গতকাল শুক্রবার ( ১১ আগস্ট ২০২৩) তারিখে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৩ উপলক্ষে “আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা ও করণীয়” শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে ঢাকার কারওয়ানস্থ ডেইলী স্টারের আজিমুর রহমান-এর মিলনায়তনে।
উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এছাড়াও এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয়-এ মৃ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-নির্বাহী পরিচালক শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুনা নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিপ্তী দত্ত, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজিম তিতিল, কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি উজ্জ্বল আজিম ও শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, প্রতিটি মানুষের একটি নীতি-আদর্শ থাকে। চিন্তাধারাকে প্রাধাণ্য দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামন্তবাদীর চিন্তাধারার ভাবাদর্শে মগ্ন হয়ে কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠা করা ঠিক নয়। তাই প্রগতিশীল চিন্তাধারার মতবাদে আদিবাসী নারী সমাজকে নীতি আদর্শের আলোকে আলোকিত হতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রগতিশীল হয়ে সমাজব্যবস্থায় প্রগতিশীল দর্শনকে কাজে লাগিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রিণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মিনু মারিয়া ম্রং সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে আদিবাসী নারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
উজ্জ্বল আজিম বলেন,আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনে আদিবাসী নারীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মধুপুর থেকে সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নারীরা প্রতিটি আন্দোলনে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। উজ্জ্বল আজিম আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত ব্যবস্থার আনুষ্ঠিকতা থাকলেও সমতলের শাসনব্যবস্থার আনুষ্ঠিকতার স্বীকৃতি নেই। সেই জায়গায় তিনি সমতলের আদিবাসীদের প্রথাগত শাসনব্যবস্থার স্বীকৃতিসহ সমতলের আদিবাসীদের পৃথক ভূমি কমিশনের দাবি জানান।
সুস্মিতা মরিয়ম বলেন, পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের প্রতি যে বৈষম্য, পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে যে শোষণ, নিপীড়ন এবং আদিবাসীদের ভূমি দখল এবং নারীদের উপর যে নির্যাতন তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সকল মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। আদিবাসীদেরউপর সকল নিপীড়ন নির্যাতন বন্ধ, তাদের অধিকার আদায়ে এবং সমাজের সকল শোষণ বৈষম্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে সকল শ্রমজীবী গণতন্ত্রমনা মানুষকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে।
দিপ্তী দত্ত বলেন, আদিবাসীদের অনুগ্রহের রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের রাজনীতির প্রেক্ষাপট সর্ম্পকে আগে জানতে হবে। তিনি আরো বলেন, উদ্বাস্তু সংস্কৃতি দিয়ে যারা রোমান্টিকতায় মেতে উঠেন সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়। সেজন্য আদিবাসী তরুনদের আরো বেশি রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
ফারহা তানজিম তিতিল বলেন, সিদ্ধান্তের জায়গায় আদিবাসী নারীদের আসতে হবে, নীতি নির্ধারণে আদিবাসী নারীদের আসতে হবে।
লুনা নূর বলেন, সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা সবসময়ই প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। আদিবাসী নারীরা সেখানে প্রান্তিকতারও প্রান্তিক অবস্থায় থাকে। আমাদের স্বীকৃতির রাজনীতি করতে হবে। সবাইকে যার যার জায়গায় এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের লড়াইয়ের জায়গা থেকে অবস্থান তৈরি করে নিতে হবে। আদিবাসী নারীদের এই পরিবর্তনের জায়গায় আরো বেশি দু’কদম বেশি অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।
এস এম রেজাউল করিম বলেন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি শিক্ষার উপর জোড় দিতে গিয়ে সবাইকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতো বলেন, মানবিক হতে বলেন।
শাহনাজ সুমী বলেন, নারীকে শুধু ভিকটিম হিসেবে না দেখে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং নারীর ক্ষমতায়িত করার সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
অজয় এ মৃ তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে হবে।
শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ে তরুণদের বেগবান হওয়া দরকার। তিনি তরুণদের বিভিন্ন আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। শান্তি দেবী বলেন, ৭০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মহিলা সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল সেটি মূলত নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই সূত্রপাত হয়েছিল।
এছাড়া মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, সুরমি চাকমা, প্রিয়ন্তী ত্রিপুরা,জয়া দেওয়ান, অংশেশৈ মারমা, লালসা চাকমা ও বিচিত্র তির্কী অংশগ্রহণ করেন।
লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সদস্য সুজয়া ঘাগ্রা।
আলোচনায় ৮টি সুপারিশমালা প্রদান করা হয়:
• আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
• পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক আইনসমূহ সংশোধন করা;
• নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় রাখা এবং সকল ধরনের নীতিমালা গ্রহণের পূর্বে আদিবাসী নারী নেতৃবৃন্দের পরামর্শ গ্রহণ করা।
• আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
• জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দসহ আদিবাসী নারীদের আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
• ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন, আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করতে হবে।
• সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।
• নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসী যুবদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।