হিল ভয়েস, ৩১ আগষ্ট ২০২৩, বান্দরবান: বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম সেটেলারদের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি আবুল কালামের বিরুদ্ধে চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন সাবেক ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)-এর কমান্ডার মেনরুং ম্রো । আবুল কালাম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৫৫ ও ৫৬ নাম্বার সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে অবৈধ গরু চোরাচালান, অবৈধ বিদেশী সিগারেট ও মদ চোরাচালানে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, বুধবার (৩০ আগস্ট) বিকালে আলিকদম উপজেলা সদরের একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন এমএনপির সাবেক কমান্ডার মেনরুং ম্রো।
সংবাদ সম্মেলনে ম্রো ন্যাশনাল পাটির এমএনপির সাবেক কমান্ডার মেনরুং ম্রো বলেন, বান্দরবান জেলা নাগরিক নাগরিক পরিষদের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ম্রো ও মারমা শ্রমিক ব্যবহার করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে অবৈধ বিদেশি গরু, বিদেশী সিগারেট, মদ চোরাচালান করে আসছে। এসবের প্রতিবাদ করার কারণে উপজেলা চেয়ারম্যান কালাম প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন এবং গত ২৮ আগষ্ট তাকে মারধর করেছেন মর্মে দাবি করেন মেনরুং ম্রো।
মেনরুং ম্রো অভিযোগ করে বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে আত্মসমর্পিত এমএনপি সদস্যরা শান্তিপুর্ণভাবে সহাবস্থান করলেও মোহাম্মদ আবুল কালাম বিগত কয়েক বছর ধরে এমনপির সাবেক সদস্যদের আর্থিক প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমন্ত পিলার ৫৫ ও ৫৬ নাম্বার এলাকা দিয়া বিদেশি গরু ও মাদক চোরাচালান করে আসছে। এক পর্যায় বাধ্য হয়ে ২০২২-২০২৩ সালের বিভিন্ন সময় মেনরুং ম্রো দলবলসহ আবুল কালাম কর্তৃক নিয়োজিত চোরাকারবারী ব্যবসায়ীদের গরুগুলো মসল্লা পাড়া ও তৈন খালের দু’টি পয়েন্টে আটকানো শুরু করেন মেনরুং ম্রো।
তখন বিনিময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার সহযোগি মোস্তফা প্রতি গরু থেকে ১৫০০-২০০০ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। এই চাঁদা থেকে গরু প্রতি ৫০০ টাকা হারে মেনরুংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত ম্রো শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও নাগরিক পরিষদের নেতা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম চাঁদার ভাগ থেকে ৬ লাখ টাকা দিলেও মেনরুংয়ের শ্রমিকদের পাওনা আরও ২১ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানান। এই পাওনা টাকা চাইতে গেলে এনিয়ে বিভিন্ন সময় কথা কাটাকাটি হয়।
মেনরুং বলেন, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চোরা পথে গরু আনা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান বিদেশী উরিস সিগারেট ও মদের অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এই কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছে মুরুংদের। তিনি নিজের উচ্চ পদ-পদবী ব্যবহার করে আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক দিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত হতে চোরাচালানী পণ্য বাংলাদেশে এনে দেশের নানান প্রান্তে পাচার করেন। চোরাইপথে আনা এইসব চোরাচালানী পণ্যের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের উরিস সিগারেট, মদের মধ্যে রয়েছে ঈগল, ব্যান্ড রয়েল, হুইস্কি ও মারডালাই রাম।
সংবাদ সম্মেলনে মেনরুং ম্রো আরো বলেন, নাগরিক পরিষদের বান্দরবান জেলা নেতা রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তিনি একে একে ৩ টি গাড়ির মালিক বনে গেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম রাত-বিরাতে আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে সবসময় যাতায়াত করেন। মিয়ানমার থেকে আনা চোরাচালানের মাদক সামগ্রী তিনি আলিকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক পথ ব্যবহার করে রাতের বেলায় পাচার করেন। মাঝেমধ্যে সড়কপথ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে মাতামুহুরী নদীর ঠান্ডারঝিরি নামক স্থানের নদী ঘাট হতে নৌপথে তৈনখালের আমতলী লংঘাটে নামিয়ে আশ্রায়ণ প্রকল্প রাস্তা ব্যবহার করে মাদকদ্রব্যাদি বাইরে পাচার করে থাকেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ী বিধায় উনার গাড়ী কেউ তল্লাশি করে না,সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি অবৈধ পণ্য পাচার করেন।
মেনরুং বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট দিনগত দিবাগত রাতে উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালামের নেতৃত্বে উনার ৩টি গাড়ীতে করে মিয়ানমার হতে প্রচুর পরিমাণ উরিস সিগারেট আনা হচ্ছিল। তখন মেনরুং ম্রোসহ তার সঙ্গীর আরো ৬ জন পাড়াবাসীকে নিয়া পাওনা টাকার জন্য তারা গাড়ির সামনে গিয়া দাড়ান। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম নিজের মালিকানাধীন গাড়ি থেকে নেমে আমাদেরকে সরে যেতে বলেন এবং তর্জন-গর্জন করে মেনরুং ম্রোর টি-শার্টের কলার ধরো টানাহেছড়া করেন, তাকে ব্যাপক মারধর করেন।
মেনরুং ম্রো বলেন, “অবৈধ মাদক ব্যবসায় আদিবাসীদের কেন ব্যবহার করছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে হুমকি দিতে দেন এবং আমাকে টেনে বিদেশী সিগারেট থাকা গাড়িতে তুলে নিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। আমার সঙ্গীদের প্রতিরোধের মুখে উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে গাড়িতে তুলতে পারে নাই। আমাকে জোর করে গাড়ীতে তোলায় বাধা দেওয়ার সময় আমার সাথে থাকা মাংলে ম্রোকে নাগরিক পরিষদের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ি থেকে নেমে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি সজোরে আঘাত করলে তিনি গুরুতর আঘাত পান। এই সময় আবুল কালাম উচ্চস্বরে হুমকি দিয়ে আমাকে অস্ত্র ও মাদক দিয়ে ফাঁসাবেন। আমি এখন হুমকির মধ্যে বসবাস করছি, তার লোকজন যে কোন সময় আমাকে মারধর করতে পারে এবং গুম করতে পারে।“
সংবাদ সম্মেলনে মেনরুং ম্রো আরো বলেন, এই সময় স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিসহ প্রশাসনকে ঘটনা জানালে ২৮ আগস্ট দিবাগত গভীর রাত আনুমানিক ২টায় আলিকদম ব্যাটালিয়ান (৫৭ বিজিবি) বিজিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখন বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদেরকে ঠান্ডারঝিরি নামক স্থানে উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকজনের লুকিয় রাখা অবৈধ উরিস সিগারেটগুলি দেখিয়ে দিলে রাত আনুমানিক ২.২০ ঘটিকার সময় বিজিবি এবং পুলিশ সদসদের যৌথ অভিযানে নয়াপাড়া ইউনিয়নের ঠান্ডারঝিরি নামক স্থান হইতে ১১,০০০ প্যাকেট বিদেশী উরিস সিগারেট উদ্ধার করে। যার আনুমানিক মূল্য ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু উদ্ধার হওয়া সিগারেটগুলি বিজিবির পক্ষ থেকে মালিকানাবিহীন দেখানো হয়।
তারই প্রতিশোধ হিসেবে গত ২৮ আগস্ট রাত সাড়ে নয়টার দিকে মেনরুং ম্রোর নেতৃত্বে আলিকদম-পোয়ামুহুরী সড়কের মেরিনচর এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে বলে সাজানো অভিযোগ করা হয়।
এদিকে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কালামকে প্রধান আসামী করে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে মারধর ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে মেনরুং ম্রোসহ মাংলে ম্রো বাদী হয়ে আলিকদম থানায় বুধবার (৩০ জুন) একটি মামলা করেন বলে স্বীকার করেন আলীকদম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার মো.তবিদুর রহমান।
উল্লেখ যে, আবুল কালামের সাথে মায়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী আরাকান লিবারেশন পাটির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। গত কয়েক মাস আগে থানচি উপজেলার সীমান্ত রোড বাগলাই এলাকায় অবস্থিত আরাকান সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতা তার বাসায় অবস্থান করেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম এর মোটরসাইকেল করে আলিকদম বাজার ঘুরে বেড়ান আরাকান বাহিনীর কমান্ডার। এরপর আরকান বাহিনীর কমান্ডার কে কক্সবাজারের ভ্রমণ করতে নিয়ে যান বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।