হিল ভয়েস, ২৯ আগস্ট ২০২৩, ঢাকা: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিধিবদ্ধ ও প্রথাগত আইন বিষয়ে রিভিউ মামলায় বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের রীতি-বিরুদ্ধ আচরণ সম্পর্কে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১ টি জাতিসত্ত্বার পক্ষে নাগরিক সমাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, ১৯০০ সালে প্রণীত The Chittagong Hill Tracts Regulation 1900 (Act I of 1900) ১৯০০ সন থেকে আজ অবধি পার্বত্যাঞ্চলের প্রশাসনের মূল আইন হিসাবে বলবৎ হয়ে রয়েছে। ১৯৯৭ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯০০ এর রেগুলেশনে কেবল দুটি সংশোধনী আনা হয়। প্রথমত, ২০০৩ সনে ২০০৩ সনের ৩৮নং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অঞ্চলের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের ক্ষমতা শাসন বিভাগের কর্মকর্তাগণের কাছ থেকে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের অধিনস্ত বিচারিক কর্মকর্তার (বিচারক) এর কাছে হস্তান্তর করা হয় (যা প্রকৃতপক্ষে ২০০৮ সনে কার্যকর করা হয়)। দিত্বীয়ত, ২০১৩ সনে, পার্বত্য জেলা সমূহের জুম চাষ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে স্থানান্তর করা হয়। অন্য কোন ক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চলের আইনি পদ্ধতিতে কোন ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি এবং অত্রাঞ্চলের প্রশাসন ১৯০০ সনের রেগুলেশন ও এর অধীনে প্রণীত বিধিসমূহের সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণভাবে আইনি ও প্রশাসনিক বিধান অত্রাঞ্চলে প্রযোজ্য হতে থাকে।
কিন্তু ২০০৩ সালে Rangamati Food Products Ltd. v. Commissioner of Customs and Others মামলায় বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট-এর হাইকোর্ট ডিভিশনে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ কে “মৃত আইন” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক হাইকোর্ট ডিভিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা হলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০, ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ কর্তৃক যা অনুমোদিত, এর পক্ষে ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করায় মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ ১৯০০ রেগুলেশনের বৈধতা বজায় রাখেন এবং ঘোষণা করেন যে ১৯০০ এর রেগুলেশন একটি সম্পূর্ণ “জীবিত ও বৈধ আইন”। উক্ত মামলাটি Government of Bangladesh v. Rangamati Food Products & Others, 69 DLR (AD) (2017) হিসেবে বা নামে প্রকাশিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-এর মর্যাদাকে স্বীকৃত রেখে উপরোক্ত Rangamati Food মামলার রায় আপিল বিভাগের অপর একটি মামলায়ও আলোচিত হয়। উক্ত মামলা হলো Wagachara Tea Estate Ltd. v. Muhammad Abu Taher and Others, 16 BLD (AD), 36 |
কিন্তু খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী জনৈক আব্দুল আজিজ আখন্দ Rangamati Food মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং- ৫৪/২০১৮ মূলে রিভিউ মামলা দায়ের করেন। অনুরূপভাবে, খাগড়াছড়ি জেলা নিবাসী আব্দুল মালেকু সুপ্রীমকোর্টের Wagachara মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং- ১৯২/২০১৮ মূলে রিভিউ মামলা দায়ের করেন। অবশেষে ২০২১ সালে রিভিউ মামলাদ্বয় সুপ্রীমকোর্টের দৈনিক কার্য তালিকার শীর্ষে পৌঁছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত একই অবস্থায় অব্যাহত রয়েছে।
উপরোক্ত Rangamati Food 3 Wagachara মামলাদ্বয়ে সরকারের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীমকোর্টে উপরোক্ত প্রদত্ত রায়ের সাথে সামজ্ঞস্য রেখে রীতি অনুসারে অ্যাটর্নি জেনারেলের অবস্থান গ্রহণ করার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে আদালতের কাছে তিনি “রাজা” সহ কতিপয় “শব্দ” ও “বাক্যাংশ” তাঁর কাছে অযথার্থ বিবেচিত হওয়ায় সেগুলো বাদ দেওয়া সহ মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রথাগত আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত সর্বমোট ১০টিরও অধিক অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছেন।
“রাজা” শব্দটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ ও অন্যান্য আইনী বিধানে উল্লেখিত হয়েছে। প্রথাগত আইনের বিষয়টি, অন্যান্যের মধ্যে, বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ (১৯০০ সনের ১ নং আইন) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ কর্তৃক স্বীকৃত। যেহেতু প্রথাগত আইন ব্যাপকভাবে মৌখিক আকারে ধারনকৃত, তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগকে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারে এবং এভাবে দেওয়াটা সুপ্রীমকোর্টের স্বাভাবিক ও সাধারণ এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে ।
উল্লেখ্য যে, বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এম.পি., পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এম.পি., প্রাক্তন মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর এবং তিন পার্বত্য জেলার সংসদ সদস্য (দীপঙ্কর তালুকদার এম.পি., কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এম.পি., ও বাসন্তি চাকমা এম.পি.) আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী জনাব আনিসুল হক-এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন যেন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭-এর সাথে সঙ্গতি রেখে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর জন্য মাননীয় আইন মন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আইন মন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও অ্যাটর্নি জেনারেল-এর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থাপনা, বিশেষত বিশদ ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রথাগত আইন, মহামান্য আদালত কর্তৃক গৃহিত হলে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুসংস্কৃতির গঠন বিন্যাস ও এই অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্টকে দুর্বল করে ফেলবে। তার ফলে সামগ্রিকভাবে সারাদেশে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক, ১২ ও ২৩ক-তে ধারণকৃত মৌলিক অভিপ্রায়েরও – যেখানে অসাম্প্রদায়িকতা ও সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা বিবৃত রয়েছে – অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থাপনা গৃহিত হলে তা ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রস্তাবনায় বর্ণিত “অনগ্রসর উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা” সম্বলিত বিধানসমূহের উপর সরাসরি আঘাত করবে এবং এগুলোর ভিত্তিতে প্রণীত ‘পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের আইন ১৯৮৯ (আইন নং ১৯, ২০ ও ২১) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮- এর উপর সরাসরি আঘাত করবে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাবাবেগকে গভীরভাবে আহত করবে, এই অঞ্চলে অসন্তুষ্টি, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং ১৯৯৭ সনের ডিসেম্বর মাসে সৃষ্ট শান্তির প্রক্রিয়াকে তীব্রভাবে বিঘ্নিত করবে।