হিল ভয়েস, ১৬ আগস্ট ২০২৩, কুমিল্লা: যে কুমিল্লা একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা মহারাজার সদরদপ্তর ছিল, যেখানে একসময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল, সেই কুমিল্লায় এখন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ভূমিহীন, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদের সম্মুখীন, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত, সংখ্যালঘু, নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে জীবনযাপন করছেন বলে জানা গেছে। এমতাবস্থায় তারা কি টিকে থাকবেন, নাকি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবেন- এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, এক সময় কুমিল্লায় ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী নিজেদের ভাষা-ঐহিত্য আর শাসন ক্ষমতা নিয়ে দাপটের সঙ্গে বসবাস করলেও কালের বিবর্তনে আজ তারা নিজেদের আদিনিবাসে স্রেফ টিকে থাকার লড়াই করছেন। নিজেদের জমি হারিয়ে অনেক আগেই জুমচাষ থেকে ছিটকে পড়া এই আদিবাসী মানুষেরা এখন দারিদ্র্য আর বেকারত্বের মধ্যে কোনোরকমে দিনযাপন করছেন।
জানা গেছে, কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড় এলাকার চারটি পল্লীতে শতাধিক ত্রিপুরা পরিবারে প্রায় পাঁচশ জন বসবাস করছেন। তাদের অধিকাংশই দিনমজুর শ্রেণির। বলা হচ্ছে, নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতি ‘প্রায় হারিয়ে’ সমতলের এই আদিবাসীরা এখন অনেকটাই ‘বাঙালির মত’ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “ত্রিপুরার রাজারা এক সময় কুমিল্লা অঞ্চলে জমিদারি করেছেন। প্রায় একশ বছর আগেও এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের ‘ককবরক’ ভাষা ও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। তবে বাংলা ভাষার প্রচলনও ছিল।”
“কিন্তু কালের বিবর্তনে এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের মতোই তাদের পেশা, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে রয়েছে। দেশ ভাগের আগে এবং পরে অনেক ত্রিপুরা কুমিল্লা অঞ্চল থেকে ভারতের ত্রিপুরায় চলে গেছেন।”
সালমানপুর ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দা মনীন্দ্র চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, “ময়নামতি-লালমাই পাহাড়টি প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। এক সময় পুরো এলাকাটি ছিল ত্রিপুরাদের। কিন্তু এখন তারাই এখানে সংখ্যালঘু।”
পল্লীতে গত বছর ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা ‘ককবরক’ রক্ষায় একটি স্কুল নির্মাণ করেছে স্থানীয় উপজেলা ও জেলা প্রশাসন। ‘ত্রিপুরা পল্লী ককবরক মাতৃভাষা স্কুল’ বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনীন্দ্র চন্দ্র ত্রিপুরা।
জানা গেছে, একসময় ত্রিপুরার মহারাজাদের অধীনে এখানকার ত্রিপুরারা বেশ ভালই ছিলেন। সংখ্যায়ও তারা ছিলেন অনেক। কিন্তু সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে এবং কুমিল্লা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। তারপর অনেকেই দেশত্যাগ করে ভারতে চালে যান।
ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, ত্রিপুরার রাজধানী ছিল উদয়পুর আর কুমিল্লা ছিল তাদের সদরদপ্তর। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলেও তখনও ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের সঙ্গে যায়নি। তারা চেয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়। কুমিল্লার জন্মভূমি থেকে ত্রিপুরাদের ভারতে চলে যাওয়া একক কোনো কারণে ঘটেনি বলে মন্তব্য করেন এই গবেষক।
তার মতে, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং মনস্তাত্বিক- এই তিন কারণে ত্রিপুরারা দেশত্যাগ করেছেন। এক সময় এই অঞ্চলে জমিদার ছিল হিন্দুরা। পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ধনিক শ্রেণির মুসলমানদের উদ্ভব বা বিকাশ ঘটে এবং দেশভাগের পর ভারতে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
“এসব কারণে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেছিল, তাদের জন্য ভারতে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এ ছাড়া সেখানে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বেশি। এসব কারণেই ত্রিপুরারা কুমিল্লা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে চলে গেছে।”
মনীন্দ্র ত্রিপুরা আক্ষেপ করে বলেন, “যারা দেশভাগের আগেপরে চলে গেছেন, তারাই ভালো আছেন! কিন্তু আমরা জন্মভূমির টানে, মাতৃভূমির টানে যেতে পারিনি। কিছুদিন আগে আগরতলার যুবরাজ এসেছিলেন আমাদের দেখতে।”
ত্রিপুরাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়েই তাদের জমি বেহাত হয়েছে, প্রভাবশালীরা দখল করেছে এবং সরকার অধিগ্রহণ করেছে। কুমিল্লার অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ত্রিপুরাদের জায়গায়।
তবে এজন্য অবশ্য ত্রিপুরারা তাদের পূর্ব পুরুষের সরলতা ও অজ্ঞতাকে দায়ী করেন। কারণ, তারা সেসময় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জমির হালনাগাদ ব্যবস্থা করে যাননি, কাগজপত্র তৈরি করেননি।
দীপঙ্কর ত্রিপুরা নামে আরেকজন বলেন, “এখানকার বয়স্ক লোকজনের অধিকাংশের পড়াশোনা নেই। কিন্তু বর্তমানে সবাই সন্তানদের পড়াশোনা করতে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। পল্লির প্রায় ৮০ শতাংশ ছেলেমেয়ে এখন লেখাপড়া করে। আমরাও চাই উন্নত জীবনের স্বাদ নিতে। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।”
পল্লিতে এখন প্রায় শতাধিক যুবক রয়েছে, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান পল্লির বাসিন্দা রেখা রানী ত্রিপুরা। তিনি মনে করেন, “সরকার ও প্রশাসন তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিলে পরবর্তী প্রজন্ম মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে।”
সালমানপুর ত্রিপুরা সম্প্রদায় কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি সজীব চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, “আমাদের ধর্মীয় কোনো মন্দির নেই, নেই শ্মশান।”
এসব বিষয়ে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া খানম বলেন, “আমি এখানে সম্প্রতি যোগদান করেছি। তবে যেটুকু জানি, ত্রিপুরা পল্লীর শিক্ষার্থীদের সরকারিভাবে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছর নতুন প্রজন্মের ত্রিপুরা শিশুদের কাছে ককবরক ভাষাটি যথার্থভাবে পৌঁছে দিতে ককবরক ভাষার স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা ত্রিপুরা পল্লীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করব বলে আশা প্রকাশ করছি।”
সূত্র: bangla.bdnews24.com