মিতুল চাকমা বিশাল
এবারের আদিবাসী দিবসের মূল সুর তথা এজেন্ডা: আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি। বলা যায়, সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত একটি এজেন্ডা। শুধুমাত্র আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নয়, বিশ্বের যেকোনো আন্দোলনে তরুণদের অংশগ্রহণ এবং তাদের সম্মুখ সারিতে অবস্থান আন্দোলনকে গতিশীল করে। অতএব, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাহলে এখন দেখা যাক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কি? আত্মনিয়ন্ত্রণ শব্দটির অর্থবোধকতা ব্যাপক। আত্মনিয়ন্ত্রণ (Self Determination) অর্থাৎ নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ, যখন সেখানে অধিকারের প্রশ্নটা জুড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটা হয় নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণের অধিকার। তাই বলে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ মোটেই উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিকভাবে নিজেদের মত করে নিজেদের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করা অথবা রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকে নিজেদের মত করে বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার দ্বারা নিজেদের পরিচালনা করা। মোদ্দাকথায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার (Right to Self-Determination) মানে স্বায়ত্বশাসন (Autonomy- ক্ষুদ্র অর্থে) এবং স্বশাসন (Autarky) বা স্বাধীনতা (বৃহৎ অর্থে)।
যেমন-১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটিয়েছিল। অর্থাৎ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে তারা নিজেদেরকে নিজেদের মত করে পরিচালনা করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার (বৃহৎ অর্থে) প্রতিষ্ঠা করেছিল। অনুরূপভাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে স্বায়ত্বশাসন প্রদান করে ভারতীয় ইউনিয়ন সেখানকার আদিবাসীদের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের (ক্ষুদ্র অর্থে) অধিকার দিয়েছে, যেমন-মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মেঘালয়, সিক্কিম ইত্যাদি। তাছাড়াও সেই সমস্ত স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যগুলির ভেতরেও আবার স্বায়ত্বশাসিত জেলা পরিষদ সৃষ্টি করে অপরাপর সংখ্যালঘু ট্রাইবাল পিপলদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমনটা মিজোরামের ‘চাকমা অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (CADC)’, ‘লাই অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (LADC)’, ‘মারা অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (MADC)’; ত্রিপুরা রাজ্যের ‘ত্রিপুরা ট্রাইবাল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (TTADC)’; আসামের ‘বোডোল্যান্ড ইউনিয়ন টেরিটরি’, ‘নর্থ কাছার হিল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ এবং ‘কার্বি আংলং অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’; মেঘালয়ের ‘খাসিয়া হিল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’, ‘গারো হিল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ এবং ‘জৈয়ন্তিয়া হিল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এ গোর্খাদের জন্য দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। একইভাবে পূর্ব মালয়েশিয়ার সাবাহ্ ও সারাওয়াক রাজ্যগুলিতেও আদিবাসীদের জন্য বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্যে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতেও এক প্রকার আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন প্রদান করা হয়েছে (যদিও এখনও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি)।
এখন আসা যাক আদিবাসী কারা এর মূল কথায়। ইংরেজি Indigenous, যার বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘দেশীয় বা স্বদেশজাত’। তবে এখানে (বাংলাদেশে) ‘আদিবাসী’ শব্দটিকেই গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে কেবল শব্দগত অর্থই মূল নয়, এখানে এর সাথে যুক্ত রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা। এদেরকে কোনো কোনো দেশে ফার্স্ট নেশন (কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র); এ্যাবরিজিন্যাল (অস্ট্রালিয়া, নিউজিল্যান্ড); নেটিভ পিপল (আমেরিকা); ট্রাইবাল (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া); জনজাতি (ভারত) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ আদিবাসীদের যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন (সেটা হোক হিল পিপলস, ট্রাইবাল, উপজাতি, জনজাতি, আদিবাসী, নেটিভ পিপল, ফার্স্ট নেশন, এ্যাবরিজিন্যাল ইত্যাদি), তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ‘যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় রত মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠী থেকে সম্প্র্ণূ পৃথক ও পিছিয়ে পড়া; যারা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের পরিবর্তে প্রথাগত রীতি-নীতি ও পদ্ধতিতেই নিজেদের সমাজ পরিচালনা করে ও বিরোধ নিষ্পত্তি করে; ভূমির সাথে রয়েছে যাদের নিবিড় ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যারা ঐতিহাসিকভাবেই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার; আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে যারা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে এবং যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তপ্রায় তারাই আদিবাসী (Indigenous)। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী রয়েছে। যারা ৭ হাজার সংখ্যাগরিষ্ট ভাষায় কথা বলে এবং ৫ হাজার ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও এই আদিবাসীরা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ এবং বিশ্বের দরিদ্রতম জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে পাহাড় এবং সমতল মিলে ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী রয়েছে, যারা প্রত্যেকেই ভিন্ন সংস্কৃতি ও ৩৯টি ভিন্ন ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ২০২২ সালে বাংলাদেশের ষষ্ঠ জনশুমারিতে আদিবাসীদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে মাত্র ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার ১৫৯ জন। অথচ ২০১১ সালে পঞ্চম জনশুমারিতে এই সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ ৮৬ হাজার। সেই সময়ে আদিবাসী নেতারা এ হিসাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তারা বলেছিলেন যে, আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ। অথচ ২০০০ সালে আদিবাসী ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত আদিবাসী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা বার্তায় বাংলাদেশে ২০ লাখ আদিবাসী আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। অপরদিকে সমতলের আদিবাসীদের জনসংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের দাবি কেবলমাত্র দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেই ৩৮টি জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ লক্ষাধিক আদিবাসী রয়েছে। তাহলে ২০০০-২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ আদিবাসী নিরুদ্দেশ কিভাবে হয়ে গেল! তাহলে কি আদিবাসীদের একটি বড় অংশ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিল? এর জবাব রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
ভূমিই আদিবাসীদের প্রাণ, ভূমিই আদিবাসীদের জীবন। এই ভূমিকে ঘিরেই গড়ে ওঠে তাদের জীবনাচার, সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আদিবাসীরা তাই ভূমিকে ‘মা’ হিসেবে সম্বোধন করে, তজ্জন্য এই ভূমির উপরে তারা কোনোদিন ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার চিন্তা করে নি। বরং আদিবাসীরা বরাবরই সমষ্টিগতভাবে ভূমি ও বনকে ব্যবহার করেছে। প্রাণ-প্রকৃতির সাথে লড়াই করে আদিবাসীরা ভূমিকে করে তোলে বাসযোগ্য। তাদের আবাস নির্মাণ পদ্ধতি ও জীবনাচারে তারা ভূমিকে অক্ষত রেখে এবং প্রাণ-প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে চলে। এই ভূমি ও বনের সাথে আদিবাসীদের থাকে নিবিড় সম্পর্ক, যেন এই ভূমি ও আদিবাসী একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আদিবাসীদের এই চিরাচরিত ভূমি আজ শাসকগোষ্ঠীর নগ্ন থাবায় দিন দিন হারাতে বসেছে। ভূমি হারিয়ে আদিবাসীরা হচ্ছে দেশান্তরী। ২০১৬ সালের রেমা-কালেঙ্গা থেকে প্রায় ২০০ জন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকের দেশান্তরী হওয়া, সাজেক থেকে লুসাইদের ৬৫টি পরিবার হারিয়ে যাওয়া কিংবা বান্দরবানের সুয়ালক থেকে ম্রো-দের উচ্ছেদ হওয়ার ঘটনাগুলো একইসুত্রে গাঁথা। তদুপুরি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধান এবং ভূমি অধিকারের জন্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ(৪)’- ধারাবলে একটি স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে এবং এই লক্ষ্যে ভূমি কমিশনও গঠিত হয়েছে। যদিও বিধি প্রণয়ন ও যথাযথ জনবল, প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাবে এই কমিশন কার্যত অকার্যকর হয়েই পড়ে রয়েছে। অপরদিকে সমতলের আদিবাসীদের জন্য কেবলমাত্র ১৯৫০ সনের ‘ভূমি ও প্রজাস্বত্ব আইন’-এর ৯৭ ধারাটিই রয়েছে, যদিও সেটি যথাযথ নয়। তদুপুরি আদিবাসী নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে সমতলের আদিবাসীদের জন্যে পৃথক ভূমি কমিশনের দাবি করে আসছে।
শুরুতেই আমি আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। আর ভূমির সাথেই জড়িয়ে থাকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নটি। অতএব, ভূমি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এই দুটি জিনিসকে আলাদাভাবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ২০০৭ সালের জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রেও আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। একইসাথে ভূমি ও ভূ-খন্ডের উপর আদিবাসীদের অধিকারকেও এই ঘোষণাপত্রে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চায় বেলায়, তাদের আভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্বশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে এবং তাদের স্বশাসনের কার্যাবলীর জন্য অর্থায়নের পন্থা ও উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার রয়েছে।’ এছাড়াও ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার (রাষ্ট্রপক্ষ) ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের (জেএসএস) মধ্যে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির মধ্যদিয়ে এক প্রকার আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন (আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার) প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির মধ্যদিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ শাসন কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে, যা এতদঞ্চলের স্থায়ী জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত আদিবাসীদের (পাহাড় এবং সমতল) আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদানের বিষয়ে এদেশের সরকার এবং রাষ্ট্র কতটা আন্তরিক? সত্যি বলতে বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে, আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে প্রায় ২০ লক্ষাধিক আদিবাসীর অস্তিত্ব ছিল, এমনকি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অনেক মন্ত্রী, খোদ প্রধানমন্ত্রীও আদিবাসী দিবসে আদিবাসীদের শুভেচ্ছা (২০০০ এবং ২০০৯) জানিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মণি বললেন যে, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, বাঙালিরাই এদেশের আদিবাসী’। এমনকি ২০১২ সালের ১২ মার্চ আদিবাসী দিবস উদযাপনে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সার্কুলার জারি করা হয় এবং একই বছরের ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস উদযাপনে বাধাও প্রদান করা হয় (খাগড়াছড়ি ও জয়পুরহাট। জয়পুরহাটে ৯ জন আদিবাসীকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ)। অপরদিকে বাংলাদেশের সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ২৬ বছর পরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করে চুক্তি সমর্থক ও কর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ফেরারি করে রাখা হয়েছে। এতে আদিবাসীদের বিষয়ে রাষ্ট্রের বিরূপ মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। মোদ্দাকথায়, এই রাষ্ট্র আদিবাসীদের প্রতি সংবেদনশীল নয় এবং তাদের অধিকারের প্রতিও সহানুভূতিশীল নয়।
বিশ্বের যেকোনো সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য একটি সুসংগঠিত জনসমষ্টি দরকার। এই জনসমষ্টি কেবল সুসংগঠিতই নয়, বরং সুনির্দিষ্ট নীতি-আদর্শ ও উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের ভিত্তিতে সুসংগঠিত জনসমষ্টি, যাকে আমরা বলি একটি রাজনৈতিক দল। কেননা অধিকারের প্রশ্নটা যখন আমাদের সামনে আর সেই অধিকারের সাথে যখন ভূমির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং শাসকগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সম্পূর্ণ সশস্ত্র ও শক্তিশালী হয়, তখন সেই অধিকারের জন্য রাজনৈতিক দলের আবশ্যকতা অবশ্যম্ভাবী। অপরদিকে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কথা অবশ্যই সামনে আনতে হয়। এখানে তরুণ বলতে কেবলমাত্র বয়সের দিকটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবেচনা করি না, তরুণ তাকেই বলি যারা বয়সের সাথে সাথে চিন্তায় তরুণ, চেতনায় তরুণ, আদর্শে তরুণ। তাছাড়া আন্দোলনের সফলতার জন্য সাহসী ও উদ্যোগী হওয়া চায়, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা থাকা চায়, পিছুটানকে বুড়ো আঙুল দেখানোর সৎসাহস থাকা চায় এবং বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত কিছুকে মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা চায়।
কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমাদের বাংলাদেশের আদিবাসী (পাহাড় এবং সমতল) তরুণদের মধ্যে সেই ধরনের সাহস, উদ্যোগ একেবারেই কম। বাস্তব পরিস্থিতি এবং কোনো বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকাতে সামগ্রিকভাবে কোনো কিছুকে তারা মূল্যায়ন করতে পারে না (পাহাড়ের তরুণদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়)। ফলশ্রুতিতে একটি সাধারণ যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তে তারা উপনীত হতে পারে না। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর বিলাসিতা তরুণদের দোদুল্যমানতা আর অধিকার সংক্রান্ত অসচেতনতাকে আরো বেশি বাড়িয়ে তুলেছে, অথচ সেটা উল্টো হওয়ারই কথা ছিল। অধিকারের বদলে তারা কেবল অর্থের পেছনে ছোটে, কিন্তু কী কারণে যে তারা আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সেই কারণটা তারা খুঁজে দেখে না এবং দেখতেও চায় না। মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অভাবে আজ পাহাড়ের তরুণরা উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে কিংবা কর্মে প্রবেশের সময় যথেষ্ট বাঁধার সম্মুখীন হয়। অথচ সেই মানসম্মত শিক্ষা কিসের ভিত্তিতে অর্জিত হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার বিষয়ে তাদের কোনো হা-হুঁতাশ নেই। আদিবাসীদের ৮০ শতাংশ তরুণই নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন নয়, এমনকি তারা জানেও না তাদের কী দরকার। যা সত্যি হতাশার এবং বেদনার। তজ্জন্যই পায়ের তলায় মাটি না থাকা সত্বেও তারা অলীক এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে থাকে। আর শাসকগোষ্ঠী শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এনে এমনিতেই তরুণদেরকে আন্দোলন বিমুখ, সংগ্রাম বিমুখ করে গড়ে তোলার এক হীন চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে। যেকারণে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল লেখকদের অনেক প্রতিবাদী ও গঠনমূলক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বাদ দেওয়াও হয়েছে। অপরদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম দিক খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে লক্ষ-কোটি সম্ভাবনা মাটিতে মুখ থুবড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো ভয়াবহ। রাষ্ট্রযন্ত্র পাহাড়ে পার্বত্য চুক্তির বিপরীতে নানা দল-উপদল গঠন করে দিয়ে এতদঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অতিদ্রুত পরিবর্তন করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সৃষ্ট সেই দলগুলো প্রকাশ্যে চুক্তিপক্ষের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার ফলে জনগণ এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কেননা সেই সমস্ত দলগুলোর সবগুলোই একেবারে সশস্ত্র। তারা নানাভাবে আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত এবং চুক্তি ও আদিবাসী অধিকারের সমর্থনে কোনো কথা বললেই তাদের উপর দেওয়া হচ্ছে নানা চাপ। ফলশ্রুতিতে তরুণ প্রজন্ম স্বতস্ফূর্তভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে পারছে না। মোদ্দাকথায় রাষ্ট্রযন্ত্র সেইসমস্ত সশস্ত্র শক্তিগুলোর দ্বারা পরোক্ষভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ব্যাহত করে দিচ্ছে এবং অবচেতন মনে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ অতি সহজে সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে অর্থাৎ এগুলোকে তারা এখন সাধারণ ব্যাপার মনে করছে। ফলশ্রুতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে না গিয়ে তারা নন্দলালের ভূমিকাতেই বেশি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তথা রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদারিত্বের সুযোগ না দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র তথাকথিত উন্নয়ন ও পর্যটনের নাম দিয়ে বিলাসিতা আর উন্মত্ততার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, আর অনেকেই সেই খেলায় পুতুলের মত আচরণ করা শুরু করেছে। অথচ সেই বিলাসিতার পর্যটনগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের ভিটেমাটি দখল করে বানানো অথবা আমাদের জীবন ও জীবিকাকে ধ্বংস করে বানানো। একদিকে যেমন রাষ্ট্রযন্ত্রের সুক্ষ্ম কৌশলে আমাদের প্রজন্মরা অধিকার নিয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে, তার অধিক সচেতনভাবেই সমাজের একটি বিশাল অংশ অধিকার সচেতনতাকে এড়িয়ে চলছে। যেন না ছুঁতে পারলেই বাঁচা যায়। কিন্তু আমরা সেই তরুণ প্রজন্ম চায় না, যে প্রজন্ম আমাদের আশার বাণী শোনাতে পারে না। আমরা সেই প্রজন্মকেই চাই, যে প্রজন্ম আমাদের মুক্তির দিশা দেখাতে পারে। আমরা এমন প্রজন্ম চাই না, যে প্রজন্ম আমাদের বাপ-দাদার অশ্রুজলের উপরে উল্লাসে ভেসে বেড়ায়, যে প্রজন্ম আমাদের হারানো ভিটেমাটিতে গিয়ে পর্যটকের বেশে ঘুরে বেড়ায়।
আদিবাসী তরুণদের অনেকেই নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলাটাকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবে দেখে। কেননা রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিক সেভাবেই তার মেকানিজমগুলোকে তৈরি করে রেখেছে। অথচ যেহেতেু, বাংলাদেশের মূল ¯স্রোতধারার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৪টি জাতিগোষ্ঠী এবং সমতলের ৪০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। এমনকি তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা-সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। এমনকি ঐতিহাসিকভাবে তারা জাতিগত শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে তাদের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার অধিকার এবং ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(৪)-এ দেওয়া আছে। অপরদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২(১)-তে আইনের সংজ্ঞায় “প্রথা ও রীতি”(‘আইন’ অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশের আইনগত ক্ষমতা সম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি) অন্তর্ভুক্ত আছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯০০ সালের শাসনবিধি এবং ২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইন (সংশোধিত-২০১৬)-এরও স্বীকৃতি প্রদান করে। অর্থাৎ একটি সংবিধানে যা স্বীকৃত তা কখনও আইনের পরিপন্থী নয়, সুতরাং আদিবাসী অধিকারের বিষয়ে দাবি তোলাটাও কখনই অপরাধ নয়। তাছাড়াও পৃথিবীর কোনো ইতিহাসেই দেখা যায় না যে, সবসময় প্রচলিত আইন মেনে সব অধিকার অর্জিত হয়েছে। অতএব, অধিকার অর্জন করতে চাইলে আইনকেও ভঙ্গ করেই এগোতে হবে এবং এ নিয়ে সংশয় থাকাটাও যথাযথ নয়।
ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন তাঁর ‘কি কঠিন জীবন’ কবিতায় বলেছেন,
‘পাহাড়ে বাঘের মুখে পড়েছিলাম, একটুও আঁচড় লাগে নি;
খোলা প্রান্তরে মানুষের মুখোমুখি হলাম, আমাকে নিক্ষেপ করা হলো বন্দীশালায়;’
যে জীবন সংগ্রামের, সে জীবন কঠিন হবেই। যে জীবন সত্য ও ন্যায়ের, সেই জীবনে বাধা আসবেই। যে জীবন নিপীড়িত মানুষের তরে, সেই জীবন মৃত্যুতেও শ্রেয়। মানুষরূপি পশুদের দল আমাদের চারিপার্শ্বে সর্বত্র, যারা সুযোগ পেলেই আমাদের আক্রমণ করবে। সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকলে সেই মানুষরূপি হায়েনাদের চোখ আমাদের উপর পড়বেই। তাই বলে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কোন অবকাশ নেই। সমস্ত প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে তাই তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত, সমস্ত কিছুতেই তরুণদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে করে তোলে অর্থবহ ও গতিশীল। তাই আগামীর দিনেও পিছুটান, হতাশা ভুলে উদ্যোগ আর সাহস নিয়ে তারুণ্যের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পাহাড় কিংবা সমতলের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে আরো বেগবান করবেই।