হিল ভয়েস, ১০ জুলাই ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গতকাল রবিবার (৯ জুলাই) ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যানিটি প্রটেকশন (সিএইচপি)-এর উদ্যোগে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলার গন্ডাতুইছা মহকুমায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয়ে গন্ডাতুইছা ও রস্যাবাড়ীর জনজাতির সামাজিক নেতৃবৃন্দের নিয়ে “পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি, ত্রিপুরা রাজ্যে এর প্রভাব ও আমাদের করণীয়” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সিএইচপির সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিরঞ্জন চাকমা এবং অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গন্ডাতুইছা দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খগেন্দ্র ত্রিপুরা ও বিশিষ্ট লেখিকা ক্রাইরী মগ।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন সরল মোহন ত্রিপুরা, পুমাং গন্ডাতুইছা, বিজয় কুমার রিয়াং, প্রেসিডেন্ট, বিএসসিও, গন্ডাতুইছা, রামজয় ত্রিপুরা, প্রেসিডেন্ট, ত্রিপুরা চুবুলাই বুথু, গন্ডাতুইছা, বৈকুন্ঠ চাকমা, সুলোআনি কার্বারী, গন্ডাতুইছা, গোপাল চাকমা, সুলোআনি কার্বারী, কাঞ্চনপুর ও পরিতোষ চাকমা, সুলোআনি কার্বারী, লংতরাই ভ্যালী। আলোচনা সভায় স্বাগত ভাষণ রাখেন দরবাচা চাকমা, প্রতিবেদন পাঠ করেন কালারাম চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সিএইচপির সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিকাশ চাকমা।
বক্তারা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার লাভের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজাতিদের উপর চলে আসা বহমান নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন, ভূমিদখল, ধর্মান্তরন সহ বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ের উপর আলোচনা করেন।
নিরঞ্জন চাকমা প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, সিএইচপি ত্রিপুরা রাজ্যের একটি মানবাধিকার সুরক্ষামূলক এনজিও। এটি গঠিত হয়েছিল ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে এবং ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগরতলার প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও করুণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হলেও দীর্ঘ ২৬ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।
রামজয় ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বার বার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শান্তি চুক্তির ২৬ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু শান্তি চুক্তির যেসব ধারা বা দাবি পূরণের কথা বলা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ পূরণ করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে সামরিক শাসন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ জনগণের উপর নির্যাতন–নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নারী নির্যাতন, ঘরবাড়ি ভাংচুরসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে। অপরদিকে সমতল অঞ্চল থেকে সেটেলার মুসলিমদের অবৈধভাবে প্রবেশ করিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের নিরীহ আদিবাসীদের ভূমিহীন করা হচ্ছে।
ক্রাইরী মগ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ আমাদের পাশাপাশি দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের আদিবাসীরা কি কম করেছে? বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বাংলাদেশের আদিবাসীরা যুদ্ধ করেছে। পাশাপাশি ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাঁই দিয়েছে। কিন্তু এই অবদান ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে আছে। ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পর আজকে আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছি। এই ইতিহাস তো অনেকেই জানেন যে, ১৯৪৭ এর সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে স্নেহ কুমার চাকমা ভারতের পতাকা তুলেছিলেন। তার কত দূরদর্শিতা ছিল।
পাকিস্তান স্বাধীনতার ৫ বছর পর আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে দেখেছি পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় কত শান্তিতে ছিল এবং সেই সময় আমাদের আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৯৮ শতাংশ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যাটা হয়ে দাড়িয়েছে অর্ধেক এরও কম। সেটেলার মুসলিম সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেটেলার মুসলিমরা আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। সুতরাং আমাদের এই সব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে, সেটা শুধু ত্রিপুরাতে নয়, সমগ্র বিশ্বে আমরা যত আদিবাসী ভাইবোনেরা আছি আমরা যদি তাদেরকে একটা সংগঠন বা প্লাটফর্মে আনতে পারি আমাদের জোরটা বাড়বে। আমরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, কারণ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের আদিবাসী ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন আছে এবং সেখানে প্রতিনিয়ত নিরীহ আদিবাসীদের হত্যা, নিপীড়ন, নারী নির্যাতন, ঘড়বাড়ি ভাঙচুর লুটপাটসহ কত কিছু না ঘটে চলেছে দিন দিন।
পরিশেষে সভাপতির বক্তব্যে নিরঞ্জন চাকমা বলেন, আমাদের সদ্য গঠিত ক্যাম্পেইন ফর হিউমিটি প্রটেকশন একটি মানবাধিকার সংগঠন। মানবাধিকার নিয়ে আমাদের আজকের এই আলোচনা সভা। আমাদের এই সংগঠনের কাজ হলো- পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মানবাধিকার আইন লংঘিত হলে আমরা সেটার প্রতিবাদ করবো, সেটা ভারত, শ্রীলঙ্কা,বার্মা, বা বাংলাদেশে হোক। হয়তো আমরা সেখানে যেতে পারবো না, কিন্তু আমরা যে যেখানে থাকি না কেন, যার যার স্থান থেকে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। সেটা আমাদের যে কোনো আদিবাসীর সঙ্গে হোক না কেন সেটা আমরা প্রতিবাদ করবো। ঠিক সেই কারণে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্ভূত নাজুক ও করুন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছি।