অশোক কুমার চাকমা
১. পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নে আমার গ্রাম, ঘিলাতুলি। গত দেড় বছর ধরে যাবো যাবো করে যাওয়া হয়নি। একটা উপলক্ষ্য পেয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ গ্রামে গেলাম। তার আগে ২৯ মে ২০২১ খ্রিঃ তারিখে গিয়েছিলাম। দেড় বছরের ব্যবধানে গ্রামে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার ছোটবেলায় দেখা গ্রামের চিত্রের সাথে বর্তমান অবস্থা মেলাতে পারছি না। দোটানায় পড়ে গেছি – প্রগতি বলবো নাকি বিচ্যুতি বলবো?
২০২২ সালের এপ্রিল কি মে’র দিকে আমার বড়ভাই ফোন করে জানিয়েছিলো। বলেছিলো, “বিজিবির লোকরা এসে বলে গেছে আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে নাকি একটা বড় রাস্তা হবে। রাস্তাটা নাকি বর্ডার পর্যন্ত নিয়ে যাবে। রাস্তাটা হলে কাঁঠাল, লিচু গাছগুলোও নাকি কাটা যাবে। এমনকি বাড়ীটাও পড়তে পারে।” বড় ভাইয়ের কথা শোনার পর আমি ভাবিনি – এত বড় রাস্তা হবে। তারপরেও তাকে বলেছিলাম এভাবে, “সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাস্তা নির্মাণ করলে তো বাধা দেওয়া যাবে না। শুধু খেয়াল রেখো যাতে তোমার বাড়ীর কোন ক্ষতি না হয়।” রাস্তা তৈরী করতে গেলে কীভাবে ক্ষতিটা কমানো যেতে পারে সে ব্যাপারে একটু পরামর্শও দিয়েছিলাম।
কবে রাস্তার কাজ সেখানে শুরু হয়েছিলো সেই কথা আর আমাকে জানানো হয়নি। জানালেও বা আমার মত কেউকেটা কী আর করতে পারতাম! যখন কাজ শেষ হয়েছিলো, তখনই জানতে পারলাম প্রায় ৪০ ফুট প্রশস্ত করে রাস্তাটা কাটা হয়েছে। আম, কাঁঠাল, লিচুসহ যেসব গাছ ছিলো, সবই কেটে ফেলা হয়েছে। বাড়ীর উঠোনও কেটে নেওয়া হয়েছে। মূল রাস্তা আর বাড়ীর দূরত্ব মাত্র ৩-৪ ফুট হবে! রাস্তা কাটার কাজ নাকি বর্ষার আগে শুরু করা হয়েছিলো।
২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছলাম। যখন লোগাং হাইস্কুলের সামনে পৌঁছেছিলাম তখন রাত নেমে এসেছিলো। সেদিন ভাইবোন ছড়ায় মায়াবিনী লেইকে তাকুমবাড়ী শরণার্থী শিবির আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী ছিলো। সেই অনুষ্ঠান শেষ করে পাঁচটার দিকে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। রওনা হওয়ার আগে আমার বড় ভাইকে ফোন করে বলেছিলাম, আমার জন্য লোগাং বনবিহার গেইটের সামনে অপেক্ষা করতে। সে সেদিন করল্যাছড়িতে একটা বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছিলো। সে আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। তাকে বনবিহার গেইট থেকে তুলে নিয়ে ঘিলাতুলির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। লোগাং হাইস্কুল পার হয়ে বুঝতে বাকী রইলো না – সীমান্ত সড়ক কত প্রশস্ত করে কাটা হয়েছে। মনে হচ্ছিলো, আমি যেন হাইওয়ে ধরে মোটর সাইকেল চালাচ্ছি।
শীতকাল। দিন ছোট। সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি রাত নেমে আসে। আমি মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলাম। নতুন রাস্তা। তার উপর বালি বিছানো আছে। খুব সতর্কতার সাথে চালাচ্ছিলাম। ফলে এদিক ওদিক তাকানোর সুযোগ হয়নি। তাছাড়া রাত, শুধু সামনের দিকে দেখে দেখে মোটর সাইকেল চালিয়েছিলাম। পথি মধ্যে চোখে পড়লো শ্রমিকদের শেড, কেউ কেউ রাস্তার পাশে বসে সিগারেট টানছিলো। মাটি কাটার এসকাভেটর, ট্রাক্টর চোখে পড়লো। সেগুলো রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে। হুড়হুড় করে মোটর সাইকেল চালিয়ে গেলাম। কতক্ষণে বাড়ী পৌঁছে গিয়েছিলাম টের পাইনি। বাড়ীর সামনে গিয়ে বড় ভাই বললো, “এখানে থামো।” প্রথমে ভেবেছিলাম, সেখানে দোকান থেকে কিছু একটা কিনবে বা নেবে। বললাম, “কী কিনবে?” সে বললো, “এটাই তো আমাদের বাড়ী। পৌঁছে গেছি।” আমি তো তাজ্জব, কত সহজে বাড়ী পৌঁছে গেলাম। আর পুরো রাস্তাটাই তো অচেনা মনে হলো। মোটর সাইকেল থামিয়ে একটু খেয়াল করলাম, সত্যিই তো বাড়ী পৌঁছে গেছি। মোটর সাইকেলটা উপরে তুলে বারান্দার নীচে রাখলাম। স্নান সেরে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম।
তারপর শুয়ে পড়লাম। চারদিক শুনশান নিরব। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, সীমান্ত সড়ক কত দ্রুত সময়ে আমাকে গ্রামের বাড়ী নিয়ে এলো। এ যাবত মেঠোপথ ধরে, রাতে হোক, বিরাতে হোক, যতবারই গ্রামে বাড়ী গিয়েছিলাম, কখনো পথ চিনতে ভুল করিনি। এবারে পথ চিনতে ভুল হলো! সীমান্ত সড়ক এলাকার চেহারা বদলে দিলো। সীমান্ত সড়ক আমার অচেনাই রয়ে গেলো।
২. ২৪ ডিসেম্বর, সকালে ঘুম থেকে উঠে শাল গায়ে জড়িয়ে ঘরের বাইরে গেলাম। গতকাল রাতে অন্ধকারে চোখ বিস্তৃত করে কিছুই দেখা হয়নি। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু বের হলাম। গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটলাম। ট্রাকগুলো ভোরবেলা থেকেই ছুটোছুটি করছিলো। দেখলাম, দু’তিনটা ট্রাক ইট বহন করে ফিরছিলো। উত্তরের দিকে (সীমান্তের দিকে) ছুটছিলো। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছগুলো আর নেই। কেটে ফেলা হয়েছে। এখনো কিছু কিছু গাছের গোড়া শিকড়সহ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।
খুব সম্ভবত ‘৮২ সাল, সেই সময় আমরা পুরনো গ্রাম থেকে কিছু পরিবার মিলে ঘিলাতুলি গ্রামে বসতি করেছিলাম। তখন খুব ছোট ছিলাম। মনে আছে, দাদুর হাত ধরে জঙ্গল সাফ করতে গিয়েছিলাম। পরে যখন ঘর বানানো হচ্ছিলো, তখনও নিয়মিতভাবে দাদুর সাথে গিয়েছিলাম। ঘিলাতুলি পাড়াতে থিতু হওয়ার পর পরই দাদু আমাদের বাড়ীর পাশে কিজিং-এর (দুই পাহাড়ের সংযোগস্থল) সামনে একটা বটগাছ লাগিয়েছিলো। দেখলাম, দাদুর লাগানো সেই বটগাছটাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কী রকম মেশিন দিয়ে এত বড় বটগাছকে উপড়ে ফেলা হয়েছে তা ভাবতেও অবাক লাগছে। ঐ বটগাছটাকে উপড়ে ফেলে কিজিং-এর ধাপে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দাদুর লাগানো বটগাছটার এরকম অপদস্থ হতে দেখে খারাপ লাগলো।
দাদুর একটা বিশ্বাস ছিলো, মরণের পরে একদিন আবার এই সংসারে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু মানব জীবনে সরাসরি আসা সম্ভব নাও হতে পারে। মানব জীবনে আসার পূর্ব পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন সময়ে বিভিন্ন যোনিতে জন্ম হতে পারে। কখনো দেবতা হয়ে থাকতে হতে পারে। যদি দেবতা হয়ে থাকতে হয়, তাহলে এ বটগাছে তার ঠাঁই হতে পারে। আত্মীয় পরিজনের কাছাকাছি থাকলে, তাদের কাছ থেকে দান-দক্ষিণা পাওয়া যেতে পারে। এতে পরকাল সুখের হবে। এছাড়া বটগাছের নিচে ছায়ায় বসে অনেকে বিশ্রাম নিতে পারবে। সুশীতল ছায়া দানের ফলে অশেষ পূণ্য হবে। পশুপাখী এসে বটগাছের ফল খাবে। এতেও পূণ্য হবে। দাদুর কাছে বটগাছ লাগানোটা ছিলো ইহকাল ও পরকালের মধ্যে সেতুবন্ধনের প্রতীক। এই বিশ্বাস থেকে দাদু ঐ বটগাছটি লাগিয়েছিলো। শৈশবে দাদুর বলা সেই গল্পগুলো আজও স্পষ্ট মনে আছে। শুধু ঘিলাতুলিতে নয়, পুরনো গ্রামেও (শনখোলাপাড়া) দু’টো বটগাছ লাগিয়েছিলো। বর্তমানে সেখানে বিজিবি ক্যাম্প আছে। ‘৮৩/৮৪ সালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্প তৈরীর জন্য ঐ বসত ভিটার জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো। দু’টো বটগাছের মধ্যে একটা এখনো বেঁচে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে।
সকাল ৭:৩০/৮:০০টার দিকে সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম। তিন ভাই মিলে একসাথে নাস্তা খেয়েছিলাম। নাস্তা খাওয়ার সময় বড় দাদা বললো, সীমান্ত বরাবর বড় রাস্তা হয়েছে। মোটর সাইকেল দিয়ে দেখে আসতে পারো। বাগানেও (কাজু বাদাম) যেতে পারবে।
বড় দাদা কী বলছিলো, প্রথমে বুঝতে পারিনি – সীমান্ত সড়ক না হয় সরাসরি ঘুরে আসতে পারবো, কিন্তু কাজু বাদাম বাগানে কীভাবে যাবো। ঐ বাগানের সাথে তো সরাসরি কোন রাস্তা নেই।
নাস্তার পরে চা খেয়ে মেজ ভাই বললো, চলো বাগানে যাই। উল্লেখ্য, গত বছর মেজ ভাইকে দিয়ে কাজু বাদাম চারা লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। চারশ’র মত চারা লাগানো হয়েছিলো। সে বললো, মোটর সাইকেলে যাওয়া যাবে। সাথে দয়া মামাও ছিলো। সে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। আমার মোটর সাইকেলের পেছনে দু’জনকে বসিয়ে রওনা হলাম সীমান্ত সড়ক বরাবর। যতই যাচ্ছিলাম, ততই দেখি অনেক বড় রাস্তা। ছোট বেলা থেকে চেনা-জানা জায়গাগুলো যেন অপরিচিত হয়ে উঠেছে সীমান্ত সড়কের কারণে। ৪-৫ মিনিট মোটর সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেলাম নতুন বিজিবি ক্যাম্পের সামনে। ছোট বেলায় সেই জায়গায় গরু চড়িয়েছিলাম। ঝাপ (ফাঁদ) পেতে কত বাদোই (এক ধরনের পাখি) ধরেছিলাম। আজ সেই জায়গায় বিজিবি ক্যাম্প। চলতে চলতে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের কাজু বাদাম বাগানে পৌঁছে গেলাম। কী আশ্চর্য, এমন রাস্তার সংযোগ তো জীবনে কল্পনা করিনি।
কাজু বাদাম পরিদর্শন শেষে বাড়ীতে ফিরলাম। দুপুরের খাবারের পরে আবার ঘুরতে বের হলাম। সীমান্ত সড়কের নির্মাণ কাজ চলছে। মোটর সাইকেল দিয়ে এক মাথা থেকে আরো এক মাথা শেষ করেছিলাম। মাইলেজ হিসেব করে রেখেছিলাম। সীমান্ত বরাবর ইতোমধ্যে মোট ৭ কিমি. রাস্তা কাটা হয়ে গেছে। এদিকে ধুধুকছড়া এলাকার রূপসেন পাড়া থেকে বাউমো ছড়া নামক পাহাড় পর্যন্ত রাস্তা কাটা হয়ে গেছে।
স্থানীয় লোকরা জানালো, এ সীমান্ত সড়ক রামগড় থেকে শুরু করে সাজেক পর্যন্ত সংযোগ করা হবে। অর্থাৎ রামগড় হয়ে সীমান্ত সড়ক ধরে সাজেক যাওয়া যাবে। আর সাজেক থেকে সীমান্ত সড়ক বরাবর খুব সহজে রামগড় দিয়ে বের হওয়া যাবে। খুব সহজেই চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় যাওয়া যাবে। সীমান্ত সড়ক সেই সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে।
সীমান্ত সড়ক পুরোটা ঘুরে বাড়ীতে ফিরলাম। জানতে চেষ্টা করলাম, গ্রামের সাধারণ লোকজন এই সীমান্ত সড়ক প্রকল্প সম্পর্কে জানে কি না। কেউই কিছু জানে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও কিছুই জানে না। শুধু এটুকুই জানে, সরকার রাস্তা বানাচ্ছে। পুরো সীমান্ত ঘিরে ফেলবে। সেনাবাহিনী এ সড়ক নির্মাণে কাজ করছে।
সত্যি বলতে কী, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প সম্পর্কে আমারও জানা ছিলো না। উপরে উপরে একটু একটু শুনেছিলাম, কিন্তু এতবড় লংকাকান্ড চলছিলো তা জানা ছিলো না। স্থানীয়ভাবে এ প্রকল্প সম্পর্কে জানার জন্য কে দায়িত্বরত আছেন, তা জানতে চাইলাম। সে ব্যাপারেও গ্রামবাসীরা সঠিক তথ্য দিতে পারল না। শুধু বললো, এক আর্মি অফিসার মূল দায়িত্বে আছেন। তাঁর দাড়ি রাঙা। সে কারণে গ্রামবাসীদের কাছে তিনি ‘রাঙাদাজ্জ্যা’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাঁর আসল নাম কী কেউ জানে না। তাঁর যোগাযোগের নম্বরও কারোর জানা নেই।
শেষ পর্যন্ত লোগাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ঐ রাঙাদাজ্জ্যার একটা মোবাইল নম্বর পেলাম। লোগাং ইউপি চেয়ারম্যান জয় কুমার চাকমা, আমার মামাত ভাই। তার কাছেও জানতে চাইলাম, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের ব্যাপারে। তিনিও খুব বেশি জানেন না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মাঝে মাঝে জনগণের পক্ষ হয়ে প্রশাসনের সাথে কথাবার্তা বলতে হয় – ঐটুকু পর্যন্তই তার প্রকল্প সম্পর্কে জানাশোনা। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম, ঐ রাঙাদাজ্জ্যার নাম মমতাজ, ওয়ারেন্ট অফিসার। পুরো নামটা তিনিও জানেন না। ঐ রাঙাদাজ্জ্যার একটা মোবাইল নম্বর পেলাম। মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসার পর ঐ মমতাজ সাহেবকে ফোন দিলাম। কিন্তু ফোনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে মোবাইল প্রম্পটে জানানো হয়। অগত্যা গুগলের আশ্রয় নিতে হলো সীমান্ত সড়ক প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য জানতে।
৩. সীমান্ত সড়ক প্রকল্প সম্পর্কে
মিডিয়ার তথ্য অনুসারে, সীমান্ত সড়ক ( রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) প্রকল্পের ১ম পর্যায় (জানুয়ারি ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় মার্চ ২০১৮ সালে অনুমোদন দেওয়া হয়। শুরুতে প্রাক্কলিত বাজেট ছিলো ১,৭০০ কোটি টাকা। এরপর উক্ত প্রকল্প অধিকতর সংশোধন করে গত ১৯ এপ্রিল ২০২২ খ্রিঃ তারিখে অনুষ্ঠিত একনেক-এর সভায় সংশোধিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ অনুমোদিত বাজেটের পরিমাণ হলো ৩,৮৬০.৮২ (তিন হাজার আটশত ষাট কোটি বিরাশি লক্ষ) টাকা। উক্ত প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এ মেয়াদে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার সীমান্ত বরাবর ৩১৭ কি.মি. সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলা হলেও সড়ক নির্মাণ কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ (Engineering Core of Bangladesh Army)।
মিডিয়ার তথ্য অনুসারে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। ১০ বছর মেয়াদে মোট ১,০৩৬ কি.মি. সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে ভারতের সীমান্ত ৩৩০ কি.মি. এবং মিয়ানমারের সীমান্ত ২১০ কি.মি.। ভারত ও মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত বরাবর সড়ক নির্মাণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
কেন সীমান্ত সড়ক?
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান বলেছেন- “Myanmar and India have borders with Bandarban, Rangamati, and Khagrachari. Therefore, border roads are being constructed to ensure security in the areas… [T]here will be more investment in the areas after the construction of the border roads. Many tourists will visit CHT to enjoy the natural beauty,” (The Dhaka Tribune, 4 December 2020). স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য খুবই পরিস্কার: (ক) ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির সীমান্ত অরক্ষিত। কাজেই এসব সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে; এবং (খ) সড়ক নির্মাণের কাজ শেষে সেখানে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হবে, বিশেষত পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সেখানে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটবে।
কিন্ত প্রশ্ন হলো, পর্যটন শিল্প কাদের মাধ্যমে? কাদের জন্য? এ পর্যটন শিল্প পরিবেশ বান্ধব হবে তো? এসব প্রশ্নের সঠিক সুরাহা না হলে সীমান্ত সড়কের কারণে সীমান্ত এলাকার নিরীহ জনসাধারণের উপকার হবে তো? তাদের জীবন জীবিকা সুরক্ষিত থাকবে তো?
সীমান্ত সড়ক প্রকল্প প্রস্তাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য পাইনি। ওয়েবসাইট গবেষণা করে পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে একটা নথি পেয়েছি (পত্র সংযুক্ত করা গেল)। ১৩ জুন ২০২২ খ্রিঃ তারিখে পরিকল্পনা কমিশনের পরিকল্পনা বিভাগের উপপ্রধান নিশাত জাহানের স্বাক্ষরে ইস্যুকৃত ঐ চিঠিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেকের) অনুমোদিত সিদ্ধান্তের আলোকে সীমান্ত সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ঐ চিঠিতে অনুমোদিত আরডিপিপি (Revised Development Project Proforma) সংযোজন করার কথাও বলা হয়েছে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে কোথাও আরডিপিপি খুঁজে পাইনি। উপ-প্রধানের স্বাক্ষরিত চিঠির উপর মার্জিনে একটা কথা লেখা হয়েছে এভাবে: “অতি জরুরি বিশেষ পত্রবাহক মারফত”। এই কথা থেকে এটা স্পষ্ট, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। সে কারণে অতি দ্রুততার সাথে সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ঘিলাতুলি গ্রামের লোকেরা জানিয়েছে, বর্ষা শুরুর আগে সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেই হিসেবে মে ২০২২ থেকে কাজ শুরু হয়। একনেক থেকে আরডিপিপির অনুমোদন নেওয়াটা আনুষ্ঠানিকতা ছিলো মাত্র।
একনেকের অনুমোদন পত্র অনুসারে, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের অনুমোদিত বরাদ্দ ৩,৮৬০.৮২ কোটি টাকা। এই পুরো টাকাটা বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে বলে বলা হয়েছে। এই বাজেটে চারটি খাত রয়েছে: (ক) রাজস্ব ব্যয়; (খ) মূলধন ব্যয়; (গ) ফিজিক্যাল কনটিনজেন্সি ও (ঘ) প্রাইস কনটিনজেন্সি। রাজস্ব ব্যয়টা মূলত বেতন ভাতা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ সেবা, জ্বালানী, যাতায়াত ও যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বাবদ পরিচালন খরচ। কনটিনজেন্সি বা অপ্রত্যাশিত ব্যয় নির্বাহের জন্য মোট বাজেটের ১.২৫% বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়ে মূলধন ব্যয়ের খাতে ৩ হাজার ৬ শত ৯০ কোটি ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা যা মোট বাজেটের ৯৬%। মূলধন ব্যয়ের অংশে ৩৩টি খাত ধরা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান খাতগুলো হলো: ক্যাম্প ও ডাকবাংলো নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ, ধারন দেওয়াল নির্মাণ, যন্ত্রপাতিসহ নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ক্রয়।
মূলধন ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে দু’টো উল্লেখযোগ্য খাত রয়েছে, যেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ বা পুনর্বাসনের বিষয়টি জড়িত। একটি হলো ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যটি হলো বনায়ন। ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মোট ১ শত ৩৭ কোটি ১৪ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ৪%। যেহেতু সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনার কোন কপি পাওয়া যায়নি, সেহেতু এটা এখনো পরিষ্কার নয় কী কী ধরনের জমি এবং কোন কোন এলাকা থেকে কী পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তবে একনেকের অনুমোদিত পত্রের সারসংক্ষেপ অনুসারে, এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১০১.১২ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণ কীভাবে করা হবে, কিংবা করা হয়ে থাকলে কীভাবে করা হয়েছে সে ব্যাপারে কোন ধারণা নেই। ভূমি অধিগ্রহণ যদি করা হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে? বা আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের জমির জন্য কোন ক্ষতিপূরণ পাবে কী না? প্রথাগত ভূমি মালিকানার জন্য কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কী রাখা হয়েছে? জমি, ফসল, গাছপালা ও শস্য নষ্ট হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য কী কোন ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব এখনো জানা নেই।
এদিকে বনায়নের জন্য থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ৬৩৪ কি.মি. এলাকার বনায়নের জন্য ৬৩৪ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এ বনায়ন কোথায়, কী ধরনের, কীভাবে এবং কাকে দিয়ে করা হবে সে ব্যাপারে এখনো ধারণা পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানী সাংবাদিক, অর্থনীতি ও উন্নয়ন গবেষকরা এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে পারেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রকল্পের নির্বাহী সংস্থা হিসেবে সড়ক পরিবহন ও মহা সড়ক বিভাগও জনগণের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপরে উল্লেখিত প্রশ্নের আলোকে প্রকল্প প্রস্তাবনা, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ।
(চলবে…)
লেখক পরিচিতি: উন্নয়নকর্মী। লেখাটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।