হিল ভয়েস, ১৭ জুলাই ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন (প্রতিবেদনটি জুম্মবার্তা, ১১শ সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২৩ থেকে নেয়া):
আদিবাসী জুম্মদের ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ ও ক্ষতিগ্রস্ত করে নির্মিত ও নির্মাণাধীন পর্যটন কেন্দ্রের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নিম্নরূপঃ
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র:
সেনাবাহিনীর ব্যবসায়িক কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান ‘সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট’ বান্দরবানের ওয়াইজংশন, চিম্বুক চূড়া এলাকা, কাপ্রু পাড়া এলাকায় নীলগিরি নাম দিয়ে ভূমি দখল করে। সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থাপিত ও পরিচালিত বান্দরবানের ‘নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র’ এর জন্য দলিল অনুযায়ী নির্ধারিত জায়গার পরিমাণ ১৬ একর। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাস্তবে এই পর্যটন কেন্দ্রের দখলে রয়েছে অন্তত ৬০ একর ভূমি। আরও অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী কর্তৃক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার ইত্যাদি স্থাপনের জন্য চিম্বুক পাহাড়ের ডলা ম্রো পাড়া (জীবন নগর), কাপ্রু ম্রে পাড়া (নীলগিরি), চিম্বুক ষোল মাইল, ওয়াই জংশন (১২ মাইল), রুমার কেওক্রাডং পাহাড়ের কেওক্রাডং চুড়া ইত্যাদি এলাকায় বসবাসরত হতদরিদ্র ও সার্বিকভাবে অনগ্রসর জুম্মদের বিপুল পরিমাণ জুমভূমি বেদখলের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এসমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুগযুগ ধরে এই এলাকার ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠীর ৬টি গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। একইভাবে একই চিম্বুক রেঞ্জ আলীকদম লামা সড়কের ক্রাউডং পাহাড়ে ২১ কিলোমিটার থেকে ২৬ কিলোমিটারে প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকা সেনাবাহিনী সংরক্ষিত এলাকা সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ১৯৮০ এর দশকে অশান্ত পরিস্থিতির সময় ঐ এলাকায় উচ্ছেদ কুলিং ম্রো পাড়াটির পুনঃস্থাপনেও বাঁধা দেওয়া হচ্ছে।
আরো জানা গেছে, চিম্বুক পাহাড়ের কাপ্রু ম্রো পাড়া এলাকায় বিলাসবহুল নীলগিরি অবকাশ যাপন কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য স্থাপিত নীলগিরি সেনাক্যাম্পের কর্তৃপক্ষ ও বান্দরবানের ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের কর্মকর্তারা কাপ্রু ম্রো পাড়ার নীলগিরি হতে জীবন নগর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থানীয়দের কোন প্রকার উদ্যান বাগান ও অন্যান্য কাজ করতে দিচ্ছেন না। সেই বিশাল ভূমি (আনুমানিক ৬০০ একর) সেনাবাহিনীর নামে নেয়া হয়েছে বলে সেনা কর্মকর্তারা দাবি করছেন।
চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্প:
স্থানীয় জুম্মদের ক্ষতিগ্রস্ত করে নির্মাণাধীন সাম্প্রতিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত পর্যটন স্থাপনা হচ্ছে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় এলাকার বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্প। এটি নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী ও বিতর্কিত সিকদার গ্রুপ (আরএন্ডআর হোল্ডিংস) এর যৌথ বিনিয়োগে নির্মাণাধীন একটি বিলাসবহুল প্রকল্প।
আদিবাসী ম্রো অধ্যুষিত এই এলাকার স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, এই প্রকল্পের ফলে ম্রোদের আনুমানিক ১০০০ একর ভোগদখলীয় ও চাষের ভূমি বেদখল হওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলে আমাদের ৬টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদের মুখে পড়বে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, পবিত্র জায়গা, শশ্মান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ম্রোদের সংরক্ষিত পাড়াবন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য অচিরেই ধ্বংস হবে।
এ পর্যন্ত ম্রো সম্প্রদায়ের জনগণ উক্ত প্রকল্প বাতিলের দাবিতে চিম্বুক থেকে বান্দরবান সদর পর্যন্ত লংমার্চসহ বহুবার মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন এবং সরকারের সকল স্তরের কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন ও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। ম্রোদের এই ন্যায্য দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে তিন পার্বত্য জেলার অন্যান্য জুম্মরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন করেছেন। এই দাবি ও আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
গত ২ নভেম্বর ২০২২ এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (সিএইচটি কমিশন) বান্দরবানের পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক আটটি গ্রামের আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের মুখে ঠেলে দিয়ে ফাইভ-স্টার (পাঁচ তারকা) হোটেল নির্মাণের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং অবিলম্বে উক্ত উন্নয়ন প্রকল্পটি বাতিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো পর্যটন প্রকল্পের জন্য স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির ভিত্তিতে সমাজের জন্য অধিকতর উদ্বেগমুক্ত স্থান নির্বাচনের আহ্বান জানায়। কমিশন উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১০৭ এবং আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রসহ ইহার আন্তর্জাতিক আইনী বাধ্যবাধকতাসমূহ শ্রদ্ধা করতে বাংলাদেশ বাধ্য। এইসব মানবাধিকার আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীসমূহকে তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে তাদের ভূমি থেকে অপসারণ করা যাবে না।
গত ১৮ নভেম্বর ২০২০ আদিবাসী ম্রেদের জায়গা-জমি দখল ও উচ্ছেদ করে সিকদার গ্রুপ এবং সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক যৌথভাবে পাঁচ তারকা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগে হিউম্যান রাইটস্ ফোরাম বাংলাদেশ উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানায় এবং অবিলম্বে উক্ত পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধ এবং প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করার দাবি জানায়। তারা ‘এটা বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জেনেভায় জাতিসংঘের ৮ জ বিশেষজ্ঞ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিতর্কিত উক্ত পর্যটন রিসোর্ট বন্ধ করার আহ্বান। তারা বলেন, বাংলাদেশের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহদাকারের পর্যটন রিসোর্ট নির্মাণ বাতিল করা। কারণ ইহা আদিবাসী ম্রো জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির হুমকি সৃষ্টি করছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরেও কয়েকজন জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ একটি যৌথ বার্তায় বাংলাদেশ সরকার এবং আরএন্ডআর হোল্ডিংস লিমিটেড ও ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন বলে জানা যায়।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ দেশের ৫৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক চিম্বুক পাহাড়ে আদিবাসী ম্রোদের ভূমিতে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি প্রেরণ করেন।
গত ২ মার্চ ২০২১ ঢাকার শাহবাগে ম্রোদের দাবির পক্ষে এবং চিম্বুকে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের নামে ম্রো আবাসভূমি বেদখলের প্রতিবাদে দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উন্নয়ন সংস্থা, আদিবাসী সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এর উদ্যোগে সংহতি সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ সরকারের নিকট চিঠি প্রেরণ করেন। কিন্তু এরপরও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ তাদের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে সেখানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ভবন নির্মাণ, পানি সরবরাহ লাইন, অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের রাস্তা নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। আর ওই পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভেতরে প্রবেশ এবং এর পাশ দিয়ে বা আশেপাশে ম্রোরাসহ সাধারণ মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, উক্ত এলাকায় এখন সবসময় সেনা সদস্য মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। কোনো জুম্ম সেদিকে চলাচল করলেই তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।
ডিম পাহাড় পর্যটন কেন্দ্র:
আলিকদম-থানচি সড়কে কথিত ‘ডিমপাহাড়’ এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। রংরাং (ক্রাউডং) পাহাড়ের উপর দিয়ে অতি সম্প্রতি সেনাবাহিনী আলিকদম-থানচি আন্ত:উপজেলা সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ জুলাই ২০১৫ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ সড়কটি উদ্বোধন করেন। বর্তমানে সেনাবাহিনী আলিকদম-থানচি সড়কের ডিম পাহাড়ের প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় ‘সংরক্ষিত প্রশিক্ষণ এলাকা’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই পাহাড়কে চাকমারা ‘রংরাং’ আর মারমারা ‘ক্রাউডং’ নামে ডাকে। মারমাদের ‘ক্রাউ’ অর্থ ডিম আর ‘ডং’ অর্থ পাহাড়। ‘ক্রাউডং’কে বাংলা অনুবাদ করে সেনাবাহিনী এ পাহাড়কে ‘ডিম পাহাড়’ নামে বাঙালিকরণ করেছে। আলিকদম উপজেলার সাঙ্গু মৌজা ও তৈনফা মৌজা এবং থানচি উপজেলার নাইক্ষ্যং মৌজার সর্বসাকুল্যে ৫০০ একর জায়গা এই পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় নেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এই এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠীর ১২টি গ্রামের ২০২ পরিবার এই পর্যটন প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জানা গেছে, বান্দরবান জেলার আলিকদম-থানচি মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকায় ১৫০টি পরিবারের অন্তত: ৫০০ জন লোক নিরাপত্তাতার অভাবে মায়ানমারে দেশান্তরিত হয়েছে।
অনিন্দ্য পর্যটন কেন্দ্র:
এছাড়া রুমা উপজেলায় আদিবাসী বম জনগণকে উচ্ছেদ করে স্থাপন করা হয়েছে অনিন্দ্য পর্যটন কেন্দ্র। এই উপজেলার সেপ্রু মৌজাধীন কথিত জীবননগর নামক এলাকায় ৫০০ একর মতো পাহাড়ভূমি সেনাবাহিনী দখলে রেখেছে। এতে তিনটি গ্রামের কমপক্ষে ১২৯ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
সাজেক পর্যটন কেন্দ্র:
সেনাবাহিনী ও বিজিবির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলার অন্যতম পাহাড়ি ও জুম্ম অধ্যুষিত এলাকা সাজেক পাহাড়ে রুইলুই ভ্যালিতে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র। বলা হচ্ছে, এই পর্যটন কেন্দ্র দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। এজন্য সেনাবাহিনী ও বিজিবির উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল কটেজ, সুদৃশ্য সড়কসহ বিভিন্ন ব্যয়বহুল অবকাঠামো। জানা যায়, কোটি টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর তৈরী কটেজের নাম দেয়া হয় থ্রিস্টার কটেজ আর বিজিবির তৈরী কটেজের নাম দেয়া হয় রুনময়। এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে ইতিমধ্যে পাঁচটি পরিবার উচ্ছেদ করা হয় এবং সেনাবাহিনী তাদের জন্য টিনের বেড়া দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে দেয় বলে জানা যায়। চিড়িয়াখানার মতো পর্যটকদের দেখার জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে সন্নিকটস্থ দু’টি গ্রামের আরো ৬৫টি জুম্ম পরিবার উচ্ছেদের শিকারে পরিণত হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও জনসমাগমের প্রেক্ষিতে সাজেকের বনজ সম্পদ, প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের উপর ইতিমধ্যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হতে শুরু করেছে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ। অপরদিকে, সাম্প্রতিককালে সেখানে কোটি টাকা খরচ করে একটি বিরাট মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, যা সাজেকের মত জুম্ম অধ্যুষিত এলাকায় এই ধরনের মসজিদ নির্মাণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ইসলামীকরণের সামিল বলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন আকর্ষণীয় স্থানগুলো পর্যটনের জন্য জবরদখল:
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৩৮৬০.৮২ কোটি টাকা ব্যায়ে ১ম পর্যায়ে সীমান্ত সড়ক ও সীমান্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং স্থানীয় জনগণ ও নেতৃত্বের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়াই শত শত জুম্ম পরিবারের শত শত একরের জুমভূমি, মূল্যবান ফলজ ও বনজ বাগান-বাগিচা, বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করা হচ্ছে এবং হচ্ছে। এতে শুধু সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে না, বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন সেনা ও বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে এবং সীমান্ত সড়কের পাশে যেখানে আকর্ষণীয় ও পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থান মনে করছে সেখানেই সেনাবাহিনী ও বিজিবি ‘সংরক্ষিত এলাকা’ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেনাবাহিনী কোনো কোনো স্থানে সীমান্ত সড়কের অতিরিক্ত জায়গায়ও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করছে ব্যাপক পর্যটন ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়ে।
যেমন- পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্দেশ্যেই রাঙামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের সীমান্ত সংযোগ সড়ক সংলগ্ন প্রত্যন্ত এলাকার জুম্ম অধ্যুষিত গাছবান গ্রামটি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বিলাইছড়ি-বরকল এলাকার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে গেলে তিনিই উক্ত ৯ জুম্ম পরিবারকে তাদের আবাসস্থল থেকে উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে যান বলে জানান গাছবান সেনা ক্যাম্পের ২৬ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর ক্যাপ্টেন মারুফ।
সেনাবাহিনীর চাপে ইতোমধ্যে উক্ত গ্রামের ২৬ পরিবারের মধ্যে ১৭ পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং বাকী ৯ পরিবারকেও সেনাবাহিনী কর্তৃক সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়ছে। অপরদিকে জুম্মদের উচ্ছেদ করা হলেও সড়কের পাশে নতুন সেনা ক্যাম্প এবং বড় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। গত ১ মার্চ ২০২৩ দুপুর আনুমানিক ১২:০০ টার দিকে সেনাবাহিনীর ৩৪ বীর বেঙ্গলের গাছবান সেনা ক্যাম্পের সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আহমেদ ও ওয়ারেন্ট অফিসার গোবিন্দের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল গাছবান গ্রামে গিয়ে চিবুক্যে চাকমা ও বসু চাকমা নামে দুই জুম্ম গ্রামবাসীর দুটি দোকান ভেঙে দেয়। উক্ত ঘটনার পর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আহমেদ আরও দুই সেনা সদস্য সঙ্গে নিয়ে বাত্যে লাল চাকমার গ্রামবাসীর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
গাছবান সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা জুম্ম গ্রামবাসীদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ওই ৯ পরিবারকে জুম চাষেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। সেনা সদস্যরা তাদের ট্রাক্টর দিয়ে মাটি কেটে এনে জুমের জন্য নির্ধারিত জায়গার উপর সেই মাটি ঢেলে দিয়েছে। এতে চার পরিবারের জুমচাষ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গাছবান ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মারুফ গ্রামে গিয়ে গ্রামের কেউ জুমে আগুন দিতে পারবে না বলে নির্দেশ দিয়ে আসেন। ক্যাপ্টেন মারুফ আরও বলেন, ‘এখানে আমি তিনমাস থাকবো, দেখবো তোমরা কিভাবে জুমে আগুন দাও।’ তারপর তিনি গ্রামবাসীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ গাছবান সেনা ক্যাম্পের ২৬ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর ক্যাপ্টেন মারুফ ও সুবেদার মো: আহম্মেদ ফারুয়া ইউনিয়নের গাছবান পাড়া এলাকার কার্বারি (গ্রাম প্রধান)সহ ৯ জুম্ম পরিবারকে নিয়ে এক সভা ডেকে ১৫ দিনের মধ্যে নিজেদের বাড়িঘর ও জিনিসপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সেনাবাহিনী সীমান্ত সড়ক নির্মাণের নামে জুম্মদের ধনসম্পদ ধ্বংসসহ স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে এবং পর্যটন ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয় জায়গাগুলো নিজেদের দখলে নিচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় সংরক্ষিত এলাকা বা সেনাবাহিনীর জায়গা বলে সাইনবোর্ডও স্থাপন করছে।
পর্যটন নিয়ে জুম্ম নাগরিক মতামত:
মানবাধিকার কর্মী ও ব্লগার জন ত্রিপুরা তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশি সামরিক বাহিনী জুম্ম আদিবাসীদের জমি ‘ট্যুরিজম’ উন্নয়নের নামে দখল করে নিয়েছে। সেনাবাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রাদিগুলি আদিবাসী স্থান ও স্থানীয় এলাকাগুলির নাম ইসলামী ও বাঙালি নামে পরিবর্তন করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘কুরুডং’ নামের স্থানটি ‘ডিম পাহাড়’ নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিলগিরি পর্যটন স্থান এর জন্য প্রায় ৬০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এছাড়া, চন্দ্র পাহাড় অঞ্চলে তাদের ৫০০ একর জমিরও বেশি জমি রয়েছে। এটি রিপোর্ট করা হয়েছে যে, প্রায় ৫০০ সদস্যের অবাঙালি (জুম্ম) জাতিসত্তার প্রায় ১৫০ জন সদস্যই বান্দরবানের আলিকদম ও থানচি এলাকা থেকে মায়ানমারে চলে গেছে, কারণ তারা তাদের জীবনযাত্রার জায়গায় ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত মনে করে। তিনি আরও বলেন, বন্দরবান জেলা প্রশাসন বান্দরবান সদরের টাইগারপাড়ার নিকটবর্তী নিলাচল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র আদিবাসী জনগণের ঐতিহ্যবাহী জুমভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। উক্ত পর্যটন কেন্দ্র আদিবাসী মানুষের ঐতিহ্যবাহী জমিতে প্রতিষ্ঠিত করা হলেও জুম্ম গ্রামবাসী এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে সুফলের কোন অংশ পাচ্ছে না। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধনী) আইন ১৯৮৯ লঙ্ঘন করে, জেলা প্রশাসন এই কেন্দ্রটি চালাচ্ছে।
২০১৫ সালে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠুক, এটা আমরাও চাই। সেটা কীভাবে গড়ে উঠবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে, এই পর্যটন শিল্পের ফলে স্থানীয়রা কতটুকু লাভবান হবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকায় পর্যটন হতে হবে সেখানকার পরিবেশ ও জনবান্ধব।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি জোয়াল লিয়ান বম বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে যেসব পর্যটন গড়ে উঠেছে তা প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশকে নষ্ট করে গড়ে উঠেছে। পর্যটকরা আসেন পাহাড়ের সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানকার আদিবাসীদের সংস্কৃতি দেখতে। তাই আমাদের নীতি হতে হবে পর্যটনের নামে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ধ্বংস করা চলবে না। পর্যটনের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়দের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্যটন উন্নয়নের বিরোধীতা করে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেন, পর্যটন বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন। জেলা পরিষদের এখতিয়ারকে উপেক্ষা করে পর্যটন করা চলবে না। জুম্মদের জায়গা-জমির ওপর পর্যটন স্পট, রিসোর্ট, মোটেল নির্মাণে সিদ্ধহস্ত তারা। তার দাবি, সাজেকে পর্যটন গড়তে গিয়ে রুইলুই এলাকার দুটি গ্রামের ৬৫টি জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
লেখক ও মানবাধিকার কর্মী মঙ্গল কুমার চাকমা ও সজীব চাকমা কর্তৃক লিখিত ‘আদিবাসী অঞ্চলে পর্যটন ও উন্নয়ন:
আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা’ এক প্রবন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম গণতান্ত্রিক নীতি হচ্ছে স্থানীয় জনগণের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ। অথচ বাংলাদেশ সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দাবি করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার হওয়া সত্ত্বেও, সর্বোপরি আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্বাচনী অঙ্গীকার করলেও এই সরকার দেশের আদিবাসীদের অধিকারকে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মতামতকে উপেক্ষা করে আদিবাসীদের জাতিগত অস্তিত্ব ও সংস্কৃতির পরিপন্থীমূলক পর্যটন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে যা কখনোই গণমুখী বলে বিবেচিত হতে পারে না।
তারা এতে আরও বলেন, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পর্যটন শিল্প সংক্রান্ত যে কোন কার্যক্রম হওয়া উচিত আদিবাসীদের বিশেষ প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি ও জীবনধারা, ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও বিশেষ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার আলোকে। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের জাতিগত বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করে এ জাতীয় কোন পর্যটন কর্মকান্ড বা উদ্যোগ যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈচিত্রময় প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন যে কোন পর্যটন ভাবনা বা কর্মকান্ড মানবিক চেতনার পরিচায়ক হতে পারে না। কিছু কিছু মহল রয়েছে যারা আদিবাসীদের প্রকৃত সমস্যা ও তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারাকে বিবেচনায় আনেন না। ফলে পর্যটন নিয়ে এখানে প্রায়ই যা করা হচ্ছে, তা সুষম উন্নয়ন তো নয়ই, বরং তা বৈষম্যমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বর্তমানে উন্নত দেশে বিশেষত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের অধিকার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিয়ে এবং ভূ-প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে যথাযথ বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় জনগণ, বন ও পরিবেশ বান্ধব ‘ইকো-ট্যুরিজম’ এর কথা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পর্যটনের ক্ষেত্রেও ইকো-ট্যুরিজমকে প্রাধান্য দিতে হবে। বস্তুত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পর্যটন হতে হবে আদিবাসী জনগণের অংশদারিত্বের ভিত্তিতে ও তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্বার্থে।
* জুম্ম বার্তা: জনসংহতি সমিতির অনিয়মিত মুখপত্র