পাহাড়ে পর্যটন: জুম্মদের উচ্ছেদ ও ভূমি বেদখলের হাতিয়ার (১ম পর্ব)

হিল ভয়েস, ১৬ জুলাই ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন (প্রতিবেদনটি জুম্মবার্তা, ১১শ সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২৩ থেকে নেয়া):

বর্তমান বিশ্বে দেশে দেশে এবং আদিবাসী অঞ্চলে পর্যটন শিল্প স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক সংযোগ ও বিকাশ এবং কর্মসংস্থানের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে এটিকে সম্ভাবনাময় ও দ্রুত বিকাশমান একটি বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও পর্যটনকে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনা করে সরকার কর্তৃক পর্যায়ক্রমে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকেও দেশের অন্যতম পর্যটন সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে কড়া সামরিক শাসন এবং বিরাজমান সশস্ত্র সংঘাত ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এব্যাপারে কেউ কার্যকর উদ্যোগ ও উৎসাহ দেখায়নি। তবে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও পর্যটন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। চুক্তিতে আদিবাসী জুম্মসহ স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ‘স্থানীয় পর্যটন’ বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মহল কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) বিভিন্ন রিসোর্ট, পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল নির্মাণসহ নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

কিন্তু পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া, বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর না হওয়া, চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘স্থানীয় পর্যটন’ বিষয়টি যথাযথভাবে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে হস্তান্তর না করাসহ যথাসময়ে ও যথাযথভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে বর্তমানে পর্যটন পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন আগ্রাসনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি মহল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বেসরকারি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক উন্নয়নের নামে এই পর্যটন এখন স্থানীয় জুম্মদের বঞ্চিতকরণ এবং তাদের ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদের অন্যতম একটি উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দীর্ঘ ২৫ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া, উপরন্তু ১৪ বছর ধরে একনাগাড়ে চুক্তি স্বাক্ষরকারী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে, উল্টো চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকা গ্রহণের ফলে এবং পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসকদের ন্যায় কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর নিকট ন্যস্ত করায় সামরিক বাহিনীই এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বহিরাগত গোষ্ঠী স্থানীয় জুম্মসহ স্থানীয় বিশেষ শাসনব্যবস্থার কর্তৃপক্ষের মতামত, সম্মতি ও অধিকারকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন পাহাড় ও আকর্ষণীয় স্থান ইচ্ছেমত দখল করে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ ও পরিচালনা করে চলেছে। এতে জুম্মরা স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে এবং নিজেদের ভূমি ও ভূখন্ডের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও জুম্মসহ স্থানীয়দের অধিকার:

১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খন্ডের ৩৪ নং ধারায় (চ) উপধারায় ‘স্থানীয় পর্যটন’কে পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তির আলোকে ১৯৯৮ সালে সংশোধিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ‘প্রথম তফসিল’-এ পরিষদের কার্যাবলীতে ২৮ নং ধারায় ‘স্থানীয় পর্যটন’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ২২ ধারায় পরিষদের কার্যাবলী হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে “পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ উহাদের আওতাধীন এবং উহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদির সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন; পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন; উপজাতীয় রীতি-নীতি, প্রথা ইত্যাদি এবং সামাজিক বিচার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান” ইত্যাদির বিধান করা হয়েছে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত হবার পরও প্রায় ১৫ বছর যাবৎ সরকার এই পর্যটন বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করেনি। অবশেষে প্রায় ১৬ বছরের মাথায় গত ২৮ আগস্ট ২০১৪ তারিখে সরকার এই ‘স্থানীয় পর্যটন’ বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করে। কিন্তু বিষয়টি হস্তান্তর করলেও সরকার এবিষয়ে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের দায়িত্ব-ক্ষমতা ও কাজের পরিধিতে চুক্তি এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের অসঙ্গতিপূর্ণ অনেক শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে।

সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত চুক্তিপত্রের শিরোনাম লেখা হয়েছে- ‘বান্দরবান/ রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার স্থানীয় পর্যটন এবং বর্তমানে উক্ত জেলায় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের স্থাপনা/ইউনিটসমূহ বান্দরবান/ রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর চুক্তিপত্র’। উক্ত শিরোনাম পাঠে সহজে বোঝা যায় যে, ‘সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলার স্থানীয় পর্যটন এবং জেলায় অবস্থিত পর্যটন কর্পোরেশনের স্থাপনা/ইউনিটসমূহ’ পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির শিরোনাম অনুযায়ী ‘পর্যটন কর্পোরেশনের স্থাপনা/ইউনিটসমূহ’ জেলা পরিষদে হস্তান্তর করার কথা বলা হলেও ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং জনবল ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা’র দায়িত্ব-ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এর হাতেই ন্যস্ত রয়েছে। অপরদিকে শর্ত (ক)-তে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘স্থানীয় পর্যটন বিকাশে সরকার বাংলাদেশ কর্পোরেশনের মাধ্যমে বান্দরবান/ রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে সমন্বয় পূর্বক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে পারিবে’ এবং শর্ত (খ)-তে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘স্থানীয় পর্যটন বিকাশে মাস্টার প্লান অনুযায়ী বান্দরবান/ রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হোটেল, মোটেল, বিনোদন স্পট, অডিটরিয়াম ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করিতে পারিবে’।

চুক্তি সংশোধন ও বলবৎকরণ এর ক্ষেত্রে (ক) শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন চুক্তিতে বর্ণিত শর্তসমূহ প্রয়োজনবোধে যৌথভাবে পর্যালোচনা করিবে এবং জনস্বার্থে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন ও সংযোজন করিতে পারিবেন’ এবং (খ) শর্তে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে- ‘চুক্তি বাস্তবায়নে এবং ইহার ব্যাখ্যার ব্যাপারে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এবং বান্দরবান/ রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করিবে’।

উল্লেখ্য যে, উক্ত চুক্তিপত্রে কোথাও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর ‘পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ উহাদের আওতাধীন এবং উহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদির সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন’ এবং ‘পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন’ করার এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু উক্ত চুক্তিপত্রে ‘স্থানীয় পর্যটন’ বিষয়ে আঞ্চলিক পরিষদের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এরূপ অসঙ্গতির মধ্যে আঞ্চলিক পরিষদ এর পক্ষে ‘স্থানীয় পর্যটন’ বিষয়ে তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হবে না।

বস্তুত মূল কর্তৃত্ব কেন্দ্রের হাতে রেখে স্থানীয় পর্যটন বিভাগ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পর্যটন বিভাগের জনবল, স্থাপনা ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার কর্তৃত্ব কেন্দ্রের হাতে রেখে পর্যটন বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার লিখিত আপত্তি জানানো হলেও সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি।

পর্যটন সংক্রান্ত জাতীয় আইন, নীতি ও পরিকল্পনা:

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালে সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ গঠন করে এবং ১৯৭৩ সাল থেকে এর কার্যক্রম শুরু করে। এই সংস্থাকে দেশে পর্যটন শিল্প বিকাশ, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ গঠিত হলে বাংলাদেশও এতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক ও সামরিক শাসন ক্ষমতাসীন হলে দেশের পর্যটন সম্ভাবনা প্রায় মুখ থুবরে পড়ে এবং এই অবস্থা প্রায় ১৯৯০ সাল অব্যাহত থাকে। জনগণের মধ্যে পর্যটন নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি; পর্যটন সম্পদসমূহ সংরক্ষণ, সুরক্ষা, উন্নয়ন; কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন; বিদেশে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা; জাতীয় সংহতি জোরদারকরণ প্রভৃতি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে সরকার জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ঘোষণা করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার জাতীয় ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন হিসেবে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড গঠন করে। ২০১০ সালে সরকার বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ও বিশেষ পর্যটন অঞ্চল আইন, ২০১০ প্রণয়ন করে। পাশাপাশি সরকার বাংলাদেশ কর্পোরেশন আদেশ, ১৯৭২ সংশোধন করে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন আইন ২০১৯ এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (সংশোধন) আইন ২০২২ প্রণয়ন করে।

উল্লেখিত দলিলের কোনো ক্ষেত্রেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বাস্তবতা আমলে নেয়া হয়নি। কোনো কোনোটিতে “ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী” নামে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পর্যটন শিল্প বিকাশ ও উন্নয়ন এবং তাদের হস্তশিল্প ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যমন্ডিত স্যুভেনির প্রস্তুত ইত্যাদি কথা বলা হলেও তাতে কোথাও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব ও উপকার/বেনিফিট অর্জন, পর্যটন উদ্যোগের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা উল্লেখপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের ভূমিকা ইত্যাদির কথা উল্লেখ নেই। স্থানীয়/আদিবাসীর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনধারা, ভূমি অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও যথাযথ বিবেচনায় রেখে পর্যটন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণের কোন বিধান রাখা হয়নি। ইকো-ট্যুরিজমের কথা বলা হলেও পরিবেশ ক্ষতি না করে কিভাবে ইকো-ট্যুরিজমের উদ্যোগ নেয়া হবে, পরিবেশ কিভাবে রক্ষা করতে হবে, ইকো-ট্যুরিজম কিভাবে আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-বান্ধব হবে ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছুই উক্ত পর্যটন নীতিতে উল্লেখ নেই।

বরঞ্চ সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও বিজিবির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে যত্রতত্র পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, পর্যটনের নামে ইচ্ছেমত ব্যাপক এলাকা জবরদখল এবং গত ১০ আগস্ট ২০১৪ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৫টি পর্যটন স্পট হস্তান্তর ও পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদান ইত্যাদি আলামত সরকার কর্তৃক আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হাতিয়ার হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় এই পর্যটন খাতকে ব্যবহার করার সুস্পষ্ট উদাহরণ বলে অনেকের অভিমত।

উক্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সেগুলি উন্নয়নের যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এবং কমিটিটি রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় প্রাথমিকভাবে ১৫টি স্থান (জীবন নগর, ডিম পাহাড়, নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাত, নীলাচল, পর্যটন কমপ্লেক্স, জীবতলি লেইক সাইড রিসোর্ট, আরণ্যক লেকসাইড রিসোর্ট, সুভলং, রিসোর্ট ইসিবি সাজেক, আলুটিলা, বাঘাইহাট, গিরিশোভা) নির্বাচন করে।

বলাবাহুল্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন বিষয়ে যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেখানে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ মূল ভূমিকা গ্রহণ করার কথা সেখানে উক্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এই প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকাকে প্রকৃতপক্ষে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪২ নং ধারা অনুযায়ী হস্তান্তরিত বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ কর্তৃক পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার বিধান এর সাথেও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার এই সিদ্ধান্তসমূহের কোন সামঞ্জস্য আছে বলে বিবেচনা করা যায় না।

তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে উপেক্ষা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আহূত এত সভায় পর্যটন নিয়ে সরকারের মাস্টার প্লানের (মহাপরিকল্পনা) অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৯৬টি পর্যটন স্থান (টুরিস্ট স্পট) চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এইসব স্থানসমূহ আবার আটটি অঞ্চলে ভাগ করা হবে। সরকার তার ইচ্ছেমত তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য একটি ব্যাপক মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। গত ১১ ডিসেম্বর ২০২২ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অধীন প্রথম সাব-কমিটির সপ্তম সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন বিষয়ে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংসদীয় সাব-কমিটির সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার এমপি, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি ও মির মুশতাক আহমেদ রবি ছাড়াও বান্দরবান সেনা রিজিয়নের কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জিয়াউল হক, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

উন্নয়ন সম্ভাবনা বনাম উন্নয়ন আগ্রাসন:

পর্যটন শিল্পের অন্যতম সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে (১) প্রাকৃতিক, (২) সাংস্কৃতিক, (৩) মানবিক ও (৪) পূঁজি ইত্যাদি উপাদানকে। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে জলবায়ু বৈচিত্র্যতা, হ্রদ, ঝর্ণা, জলপ্রপাত, বন-জঙ্গল, ফল-ফুল, বন্যপ্রাণী (পশু-পক্ষী-মাছ), পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত, গুহা, পাথর-খনিজ, ফসিল ইত্যাদি রয়েছে। সাংস্কৃতিক সম্পদের মধ্যে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থাপনা ও স্থান, ধর্মীয় স্থান, জাতিগত ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা, পূজা-পার্বন, উৎসব, ঐতিহ্যগত ক্রীড়া ইত্যাদি এবং মানবিক সম্পদের মধ্যে আদিবাসী জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসাশ্বাস্ত্র, আচার-ব্যবহার, আপ্যায়ন নৈপুন্যতা, বুনন ও হস্তশিল্প, চারুকলা, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, পালা-গীত, খাদ্যপ্রণালী ইত্যাদিকে নির্দেশ করা হয়ে থাকে। সুতরাং বলা যেতে পারে, পর্যটন শিল্প বিকাশের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান রয়েছে। ফলে পার্বত্য চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ি-বাঙালি স্থানীয় অনেক উদ্যোক্তা ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে পর্যটন সহায়ক বিভিন্ন রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন শুরু করে যা স্থানীয় জনগণের মধ্যে উন্নয়ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। কিন্তু সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করা, চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন কার্যকর না করা, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ে সৃষ্ট বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর না করা, চুক্তির আলোকে স্থানীয় পর্যটন বিষয়টি হস্তান্তর এবং পরিচালনা না করার কারণে বর্তমানে পর্যটন বিষয়টি বিশেষ করে সামগ্রিকভাবে জুম্মদের জন্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র না হয়ে তাদের জাতিগত অস্তিত্ব, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতা, বন ও ভূমির উপর তাদের প্রথাগত অধিকার, ঐতিহ্যবাহী জীবন-জীবিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সরকার কর্তৃক চুক্তির শর্ত বরখেলাপ এবং সরাসরি সামরিক বাহিনী ও বহিরাগত গোষ্ঠী কর্তৃক পর্যটন বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ লাভ করায় এই উদ্বেগজনক বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে।

পর্যটন কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত ভূমিগুলো হচ্ছে জুম্মদের মৌজা ও জুমভূমি যেখানে আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় প্রথাগতভাবে জুম চাষ ও বাগান-বাগিচা সৃষ্টি করে আসছে। বন, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসীদের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং এসব এলাকায় জুম চাষ, বাগান-বাগিচা গড়ে তোলা, মৌসুমী ক্ষেত-খামারে জুম্মদেরকে বাধা দেয়া হচ্ছে। এর ফলে জুম্মদের জীবন-জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা, তাদের বাস্তুভিটা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য।
(চলবে…)

* জুম্ম বার্তা: জনসংহতি সমিতির অনিয়মিত মুখপত্র

More From Author