হিল ভয়েস, ৮ জুলাই ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার ২নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নে বসবাসকারী বহিরাগত সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী কাপ্তাই উপজেলার ৪নং কাপ্তাই ইউনিয়ন এলাকায় ১২ জুম্ম পরিবারের অন্তত ২৪ একর জলেভাসা ধান্য জমি জোরপূর্বক বেদখলের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের তাদের জমিতে চাষের কাজে বাধা দিচ্ছে এবং কাজ বন্ধ না করলে রক্তপাত হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জুলাই ২০২৩, ১৩০ নং বারুদগোলা মৌজার কাপ্তাই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের কিল্ল্যাছড়ি ভাবনা কেন্দ্র পাড়া গ্রামের অধিবাসী পুলক কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৩৪) পীং-নোয়া মুনি তঞ্চঙ্গ্যা ও একই গ্রামের দয়া মন চাকমা (৬৮) পীং-মৃত কিনাধন চাকমা, তাদের জলেভাসা জমি সংস্কারের জন্য বিশ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ করতে যায়।
এমন সময় পার্শ্ববর্তী বিলাইছড়ি উপজেলার ২নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের কেংড়াছড়ি সেটেলার এলাকা হতে বর্তমান ইউপি মেম্বার মোঃ রবিউল, পীং-মৃত রফিকুল এর নেতৃত্বে ৪০/৫০ জন সেটেলার বাঙালি সেখানে গিয়ে পুলক কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও দয়া মন চাকমাকে এবং তাদের শ্রমিকদের জমিতে কাজ করতে পারবে না বলে জানায় এবং কাজ বন্ধ না করলে রক্তপাত হবে বলে জানিয়ে দেয়।
এসময় সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের হুমকি দিয়ে বলে যে, পার্শ্ববর্তী সব জমি তাদের হেফাজতে থাকবে, না হয় গণহত্যা চলবে। সেটেলার বাঙালিরা আরও বলে যে, তারা স্থানীয় সেনা জোনের সিও (কমান্ডিং অফিসার) এর নিকট গিয়ে মামলা করবে এবং সিও সাহেব নাকি এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেবে।
সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক বেদখলের চেষ্টার শিকার ভুক্তভোগী জমির মালিকরা হলেন- ১. পুলক কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৩৪) পিতা-নোয়া মুনি তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ১ একর; ২. দয়া মন চাকমা (৬৮) পিতা-মৃত কিনাধন চাকমা, তার জমির পরিমাণ ১ একর; ৩. নিজল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৩৬) পিতা-হনুমান তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ১ একর; ৪. অভিমন্যু তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮) পিতা-মৃত শুভং তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ৫. রজিন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৩৩) পিতা-মৃত শুভং তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ২ একর; ৬. গুনবীর চাকমা (৩১) পিতা-বিমল চাকমা, তার জমির পরিমাণ ২ একর; ৭. ধনঞ্জয় চাকমা (৩৫) পিতা-বিমল চাকমা, তার জমির পরিমাণ ২ একর; ৮. তরুণ জ্যোতি চাকমা (৪১) পিতা-বিমল চাকমা, তার জমির পরিমান ২ একর; ৯. লিটন চাকমা, তার জমির পরিমান ১ একর; ১০. রেনু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৪২) পিতা-মৃত হনমান তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ১১. নয়ন কুমার (২৭) পিতা-অলঙ্গ তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ১২. মেলো তঞ্চঙ্গ্যা (৫৫) স্বামী-অলঙ্গ তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমান ৩ একর। তারা সকলেই কাপ্তাই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের কিল্ল্যাছড়ি ভাবনা কেন্দ্র পাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এর আগেও গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সেনাবাহিনীর বীর ৩২ বেঙ্গল এর সিও লেঃ কর্নেল মোঃ আহসান হাবিব নাসীম এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার মহর আলী ও ২নং ওয়ার্ড মেম্বার নজরুল এর নেতৃত্বে একদল সেটেলার বাঙালি কিল্ল্যাছড়ি ভাবনা কেন্দ্র পাড়া গ্রামের ১২ জুম্ম গ্রামবাসীর প্রায় ৩৪ একর জলেভাসা জমি জোরপূর্বক বেদখল করা হয়। বেদখল করা ঐ জমি জুম্মদের বঞ্চিত করে সেনাবাহিনী ও সেটেলার নেতাদের কর্তৃক প্রায় ৪০/৫০টি সেটেলার বাঙালি পরিবারকে প্রদান করা হয়।
ভুক্তভোগী উক্ত জুম্ম পরিবারগুলি হল- ১. অমর চাকমা (৩৬) পিতা-মৃত অলিন্দ্র চাকমা, তার জমির পরিমাণ ২ একর; ২. নির্মল তঞ্চঙ্গ্যা (৪২) পিতা-মৃত চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ৩. কমাত্ব তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫) পিতা-কচ্চো তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ৪. বিনোত্রি তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮) স্বামী-গলায়্যা তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ৫. কালা মুনি তঞ্চঙ্গ্যা (৫০) পিতা-কেশজ্যা তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৪ একর; ৬. মঙ্গল জ্যোতি তঞ্চঙ্গ্যা (৩৮) পিতা-নন্দী গোপাল তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ৪ একর; ৭. ইন্দু কুমার চাকমা (৬২) পিতা-মৃত গদারাম চাকমা, তার জমির পরিমাণ ৩ একর; ৮. করুনা মুখী তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫) স্বামী-চিরন জিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, রেশম বাগান, তার জমির পরিমাণ ৫ একর; ৯. প্রিয়দর্শী তঞ্চঙ্গ্যা (৫২) পিতা-আদি চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ২ একর; ১০. সঞ্চয় তঞ্চঙ্গ্যা পিতা-নীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ১ একর; ১১. সমীরণ তঞ্চঙ্গ্যা (৪০) পিতা-বীর মুনি তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ১ একর; ১২. নীলু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৪৭) পিতা-রাজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, তার জমির পরিমাণ ২ একর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী জানান, বর্তমানে সেনাপ্রশাসন সেটেলার বাঙালিদের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে সহযোগিতা দেওয়ার কারণে স্থানীয় পুরানবস্তি বাঙালিসহ জুম্ম জনগণ অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিদিন উপজেলার কোনো না কোনো এলাকায় সেনাবাহিনী অপারেশন ও তল্লাসি চালিয়ে জুম্ম জনগণকে চাপের মুখে ও ভয়ভীতির পরিবেশে থাকতে বাধ্য করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক অধিকারকর্মী বলেন, যুগ যুগ ধরে জলেভাসা জমিসমূহ জুম্মসহ স্থায়ী অধিবাসীরা ভোগদখল করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের শর্ত অনুযায়ী, জুম্মরাই এসব জলেভাসা জমির মালিক। কিন্তু বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনকে লংঘন করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালিরা এসব জমি জুম্মদের কাছ থেকে জোরপূর্বক বেদখল করছে। এভাবে চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনিবার্যভাবে সংঘাতের সৃষ্টি হবে।