হিল ভয়েস, ১২ জুলাই ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন (প্রতিবেদনটি জুম্মবার্তা, ১১শ সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২৩ থেকে নেয়া):
সরকার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে চারিদিকে ঘিরে ধরার মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই অংশ হিসেবে উন্নয়ন ক্ষেত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ, জীবন-জীবিকা বিপন্ন করা, অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া, এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একতরফা রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট জুম্মদের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি লিজ দেয়া, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্যাস-তেল অনুসন্ধান ইত্যাদি অন্যতম।
সীমান্ত সড়ক:
এ ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের একটি হচ্ছে সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। ‘সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পাবত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্প’ নামক প্রকল্পের অধীনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সীমান্তে ৩১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত রয়েছে ২১০ কি.মি.। ভারত ও মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত বরাবর সড়ক নির্মাণ করা হবে।
সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) প্রকল্পের ১ম পর্যায় (জানুয়ারি ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় মার্চ ২০১৮ সালে অনুমোদন দেয়া হয়। শুরুতে প্রাক্কলিত বাজেট ছিলো ১,৭০০ কোটি টাকা। এরপর উক্ত প্রকল্প অধিকতর সংশোধন করে গত ১৯ এপ্রিল ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত একনেক-এর সভায় সংশোধিত বাজেট অনুমোদন দেয়া হয়। সর্বশেষ অনুমোদিত বাজেটের পরিমাণ হলো ৩,৮৬০.৮২ টাকা। উক্ত প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। ১০ বছর মেয়াদে মোট ১,০৩৬ কি.মি. সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে।
একনেকের অনুমোদনপত্র অনুসারে, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের পুরো টাকা বাংলাদেশ সরকারের কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে বলে বলা হয়েছে। এই বাজেটে চারটি খাত রয়েছে: (ক) রাজস্ব ব্যয়; (খ) মূলধন ব্যয়; (গ) ফিজিক্যাল কনটিনজেন্সি ও (ঘ) প্রাইস কনটিনজেন্সি। রাজস্ব ব্যয়টা মূলত বেতন ভাতা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ সেবা, জ্বালানী, যাতায়াত ও যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বাবদ পরিচালন খরচ ধরা হয়েছে। কনটিনজেন্সি বা অপ্রত্যাশিত ব্যয় নির্বাহের জন্য মোট বাজেটের ১.২৫% বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে মূলধন ব্যয়ের খাতে ৩ হাজার ৬ শত ৯০ কোটি ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা, যা মোট বাজেটের ৯৬%। মূলধন ব্যয়ের অংশে ৩৩টি খাত ধরা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান খাতগুলো হলো: ক্যাম্প ও ডাকবাংলো নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ, ধারণ দেওয়াল নির্মাণ, যন্ত্রপাতিসহ নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ক্রয় ইত্যাদি।
প্রকল্পের নথি অনুসারে প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো- পার্বত্য জেলাসমূহের সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকরণ, সীমান্তের দুই পাশের অবৈধ ব্যবসা (অবৈধ অস্ত্র, অবৈধ ড্রাগস, মানব পাচার ইত্যাদি) বন্ধকরণ, পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধিকরণ, সীমান্ত এলাকায় কৃষি পণ্য দেশের মূল ভূখ-ের কৃষি পণ্যের সাথে সংযোগের মাধ্যমে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, পার্বত্য এলাকার কৃষিপণ্য এবং ফসল ও উন্নতজাত পণ্য বৃদ্ধিকরণ, পার্বত্য জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিকরণ, পার্বত্য জেলার দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতিকরণ, পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য সহায়তা প্রদান করা, পার্বত্য জেলার দূর্গম সীমান্তবর্তী এলাকায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টিকরণ।
সংযোগ সড়ক:
সীমান্ত সড়কের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আরো রয়েছে অনেক সংযোগ সড়ক বা লিঙ্ক রোড। এসব সংযোগ সড়ক বা লিঙ্ক রোডের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
১। সংযোগ সড়কের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সংযোগ সড়ক। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় নির্মাণাধীন ঠেগা স্থল বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম সুমদ্র বন্দরের সংযোগের জন্য রাজস্থলী থেকে ঠেগামুখ পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। জানা গেছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৬ ইসিবি বর্তমানে রাজস্থলী হতে বিলাইছড়ি পর্যন্ত সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজ পরিচালনা করছে। বর্তমানে বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়ন হয়ে জুরাছড়ি উপজেলার সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা কাটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
২। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের সিজকছড়া থেকে সাজেক-শিলদা-বেতলিং সংযোগ সড়ক, যার দৈর্ঘ হচ্ছে ৫২ কিলোমিটার। এই সংযোগ সড়ক সাজেক-দোকানঘাট-ঠেগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার সীমান্ত সড়কের সাথে সংযোগ হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি (ইঞ্জিনিয়ার্স কন্সট্রাকশন ব্যাটিলিয়ন) শিজকছড়া থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা উদয়পুর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করছে। এছাড়া উদয়পুর থেকে উত্তরে ১০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণাধীন রয়েছে।
৩। আলিকদম উপজেলা হতে আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার নিরাপত্তা জোরদার হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি আলিকদম উপজেলায় কুরুক পাতা ইউনিয়নের সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগ স্থাপন ও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের উৎপাদিত কৃষি ও জুমজাত পণ্য বিপননে ভূমিকা রাখবে বলে প্রকল্পের নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার নিরাপত্তা জোরদার হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি আলিকদম উপজেলায় কুরুক পাতা ইউনিয়নের সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগ স্থাপন ও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের উৎপাদিত কৃষি ও জুমজাত পণ্য বিপননে ভূমিকা রাখবে বলে প্রকল্পের নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়।
২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ নির্মাণ প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ন (১৬ ইসিবি)। এই সড়কটি দোছড়ির পাইনছড়ি থেকে থানছি সীমান্ত সড়কের সাথে সংযোগ হবে। জানা গেছে যে, ২০১৭ সালের মে মাসে সড়কটি নির্মাণের জন্য ৩ শত ৭৪ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক। এছাড়াও প্রকল্পে ২০ হাজার ৬ শতটি বৃক্ষরোপণ এবং গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নখাত বরাদ্দ রয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে- ৮ লাখ ৭৬ হাজার ঘনমিটার মাটি কাটা, ১২ টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট, ১শ মিটার ওয়ার্টার ডেম (২/৩টি), ৯ শত ১৯ মিটার (১২টি) আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ, ৭২ মিটার (১১টি) আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ৪৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার সাইড ড্রেন নির্মাণ, ১ শত ৩১ দশমিক ৮৪ মিটার ৫৫টি ক্রস ড্রেন নির্মাণ, ১ হাজার ৮ শত ৫৪ মিটার রিটেইনিং ওয়াল ও ব্রেস্ট ওয়াল নির্মাণ, ৯৫ মিটার বল্টা প্যালাসাইডিং প্রভৃতি।
৪। বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের আর্য্যপুর বনবিহারের কাছাকাছি উগলছড়ি গ্রাম হতে ৩০ ফুট প্রস্থ সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করছে সাজেক ইউনিয়নের ১০নং ক্যাম্পের সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাক্টশন ব্যাটেলিয়ন। উক্ত জায়গা থেকে কজোইছড়ি মুখ হয়ে হালিমপুর বিজিবি সীমান্তবর্তী ক্যাম্প পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে এই সংযোগ সড়কটি। আর সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের তাংগুম মুখ ব্রিজ থেকে ঐ কজোইছড়ি ক্যাম্প বিজিবি রাস্তার সাথে সংযুক্ত হবে।
ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন:
সীমান্ত সড়কের মূলধন ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে দু’টো উল্লেখযোগ্য খাত রয়েছে, যেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ বা পুনর্বাসনের বিষয়টি জড়িত। একটি হলো ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যটি হলো বনায়ন। ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মোট ১ শত ৩৭ কোটি ১৪ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ৪.০%। একনেকের অনুমোদিত পত্রের সারসংক্ষেপ অনুসারে, এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১০১.১২ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ কীভাবে করা হবে, কিংবা করা হয়ে থাকলে কীভাবে করা হবে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা দেয়া নেই। ভূমি অধিগ্রহণ যদি করা হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে তার কোনো তথ্য কোথাও উল্লেখ নেই। প্রথাগত ভূমি মালিকানার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা জানা নেই। জমি, ফসল, গাছপালা ও শস্য নষ্ট হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য কী কোনো ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা তাও জানা নেই।
এদিকে বনায়নের জন্য থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ৬৩৪ কি.মি. এলাকায় বনায়নের জন্য ৬৩৪ কোটি থোক পরিমাণ ধরা হয়েছে। এই বনায়ন কোথায়, কী ধরনের, কীভাবে এবং কাকে দিয়ে করা হবে সে ব্যাপারে এখনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
(চলবে…)
* জুম্ম বার্তা: জনসংহতি সমিতির অনিয়মিত মুখপত্র