হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবসে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিততে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছরপূর্তিতে অপহরণ ঘটনার যথাযথ বিচার, জুম্ম নারীর নিরাপত্তাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ (১২ জুন ২০২৩) সকাল ১০ টায় সংগঠনের রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন উলিসিং মারমা এবং সঞ্চালনা করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য ভদ্রাদেবী তঞ্চঙ্গ্যা।
প্রতিবাদ সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান। এছাড়া আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি রীতা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি’র মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আশিকা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা। প্রতিবাদ সভায় সংগঠনের বিবৃতি পাঠ করেন হ্লাসিং দাই মারমা।
প্রতিবাদ সভায় প্রধান বক্তা অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান বলেন, অপহরণ ঘটনার পরপরই কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার অভিযোগ স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এতে স্পষ্ট দেখা যায়, রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নাজুক। যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়। এতে দোষীরা আরো এহেন হীন কর্মকান্ড করতে উৎসাহ পাবে।
তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থার নাজুক অবস্থার কারণে, পাহাড়ে জুম্ম নারীদের যৌন নিপীড়ন বেড়ে চলেছে। প্রত্যেকটা তদন্তে এসেছে যে, স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় কল্পনা অপহরণের শিকার হয়েছে। প্রত্যেক তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, অভিযোগের সত্যতা আছে। অভিযোগ মিথ্যা হলে এতদিন কালিন্দী কুমার চাকমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রদানের নামে উল্টো মামলা দেয়া হত।
তিনি আরও বলেন, আদালত আগামী ২৬ জুন, ২০২৩ তারিখে শুনানির দিন ধার্য করেছেন বলে বাদীর পক্ষ থেকে জানা গেছে। আমরা মামলাটি জেলা জর্জ কোর্ট থেকে উচ্চ আদালতে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমাদের লড়ে যেতে হবে। কল্পনা লড়াই করেছিলেন বলে, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। কল্পনা সংগ্রামের প্রতীক।
এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এর সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা স্মৃতিচারণ করে বলেন, কল্পনা চাকমা গরীব জুম্ম পরিবারের সন্তান হলেও তিনি ছিলেন অধিকার সচেতন। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ। তিনি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদ করতেন। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বলে শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে দিবাগত রাতে নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে কল্পনাকে অপহরণ করে।
এছাড়াও, তিনি জুম্ম নারীদের কল্পনার মতো সংগ্রামী ও আদর্শিক জীবন গঠন করার জন্য আহ্বান জানান।
প্রতিবাদ সভার সভাপতি উলিসিং মারমা কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সুবিচার নিশ্চিতকরণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে অতি দ্রুত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিসহ নিম্নোক্ত দাবিগুলো তুলে ধরেন-
১। অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২। দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩। জুম্ম নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, এদিন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়-
“আজ ১২ জুন ২০২৩, পার্বত্য অঞ্চলের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৭ বছর। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সেনা সদস্য কতৃর্ক অপহরণ করা হয়। এ সময় অপহরণকারীরা কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। কল্পনার দুই ভাই টর্চের আলোতে স্পষ্টতই অপহরণকারীদের মধ্য থেকে বাড়ির পাশ^র্বতী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে: ফেরদৌস (মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মো: নুরুল হক ও মো: সালেহ আহমদকে চিনতে পারেন।”
এতে আরও বলা হয়, “শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান এবং পার্বত্যবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেটেলার বাঙালি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কল্পনা চাকমা অপহরণের দীর্ঘ ২৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ২৭ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে পারেনি। যথাযথ বিচার করতে পারেনি মানবতা বিরোধী এই জঘন্য ঘটনার। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের বিচারহীনতার একটি হীন দৃষ্টান্ত। দেশের নারী সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা ও বঞ্চনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির এটি একটি জঘন্য পরিহাস! এটাই আঙুল দিয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দেয় সামরিক যাঁতাকলে চরমভাবে পিষ্ট জুম্ম অধ্যুষিত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম।”