হিল ভয়েস, ১৭ জুন ২০২৩, পটুয়াখালি: পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় নির্মাণাধীন পায়রা বন্দরের কারণে উচ্ছেদ হওয়া ছ-আনী পাড়ার রাখাইনদের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। আজ শনিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রেসক্লাবে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সরেজমিন পরিদর্শনরত নাগরিক প্রতিনিধি দল।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ নাজমুল হক প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, কলাপাড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি হুমায়ন কবীর প্রমুখ।
সভায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই রাখাইনদের পুনর্বাসনের কথা দেওয়া হলেও তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি আমরা আসলে সত্যিই লজ্জ্বিত। আমরা দেখেছি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পাহাড়ের চাকমা জনগোষ্ঠীদের যেভাবে পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা হয়েছিল তা এখনো সে জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। এখানেও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ছ-আনী পাড়ার মাত্র যে ছয় পরিবার ছিল তাদেরকে উচ্ছেদ করেছে। এটা একেবারেই দুঃখজনক। আমরা চাই দেশটা ফুলের বাগানের মত হোক। ফুলের বাগানে কেবল গোলাপ থাকে না। সব ফুলই যেন বিকশিত হতে পারে। তার জন্য সাংবাদিকদেরকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে । তবেই আমরা সংখ্যালঘু সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বরগুনা ও পটুয়াখালী এলাকায় অনেক আগে থেকেই রাখাইন জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। কিন্তু এই সংখ্যা এখন পাঁচ হাজারেরও কম। অবস্থা এমন যে, তারা এখন শুধু সংখ্যালঘুই নন, তারা বিলুপ্তির পর্যায়ে। একইসঙ্গে নানা ধরনের মামলা, হামলা, দখলদারিত্বের কারণে তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। পায়রা বন্দরের কারণে উচ্ছেদের কারণে ছ-আনী পাড়ার রাখাইনদের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দরকার ছিল। কিন্তু তাদের তেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের নৃবিজ্ঞানের ভাষায় ‘আনপিপলিং’ বলে একটা কথা আছে। এর মানে হল একসময় কোনো একটা অঞ্চলে কোনো এক জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা আর সেখানে নেই। তাদের সাংস্কৃতিক কিছু বিষয় অবশিষ্ট আছে কেবল। এই পটুয়াখালী অঞ্চলে এসে আমরা তার প্রমাণ দেখতে পায়।
তিনি আরো বলেন, এই সম্প্রদায়কে ভূমিহীনদের মতো অন্যান্যদের সঙ্গে পুনর্বাসন করার পায়তারা চলছে। কিন্তু তারা তো ভূমিহীন নন। তাদের বাড়িঘর ছিল, উঠান ছিল। তাহলে তাদেরকে কেন ভূমিহীনদের মতো পুনর্বাসন করা হবে।কিন্তু একটি রাখাইন পরিবারের সঙ্গে একটি বাঙালি পরিবারের সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। বাঙালি পরিবারের সঙ্গে তারা থাকলে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। এজন্য তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসন জরুরি।
জাকির হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, নাগরিক উদ্যোগ- আজ সংবিধানকে না মেনে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, এটা অমানবিক। তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, দরিদ্রদের মতো পুনর্বাসন করা হচ্ছে। শুধু পটুয়াখালীই নয়, বরং সারাদেশেই এটা চলছে। এই ছয় পরিবারের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চা আলাদা। তাদের অবশ্যই পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের যেখানে পুনর্বাসন করা হবে, সেখানে শশ্মান, উপাসনালয় ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা প্রয়োজন।
ছ-আনী পাড়ার উচ্ছেদ হওয়াদের অন্যতম সিং দা মো রাখাইন বলেন, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বলেছিল সম্মানজনক পুনর্বাসন করবে।তার আগ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ীতে রাখার যে কথা তাও তারা রাখেনি। ছয় মাস বাসা ভাড়া দিয়ে তারা আর কোনো ধরণের খরচ দেয়নি। আমরা চাই আমাদেরকে সম্মানজনক পুনর্বাসন করা হোক। আমাদেরকে এমন রাখাইন পাড়ায় পুনর্বাসন করা হোক যেন যেখানকার শশ্মান, বৌদ্ধ মন্দির ও পুকুর আমরা ব্যবহার করতে পারি। ছ-আনী পাড়ায় আমরা যেভাবে ছিলাম, সেভাবেই যেন আমাদেরকে রাখা হয়। আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নয়। কিন্তু মানুষকে উচ্ছেদ করে যেন উন্নয়ন করা না হয়।
মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক ও আইনজীবি এডভোকেট প্রকাশ বিশ্বাস, সাংবাদিক হারুন-অর রশীদ, কালের কন্ঠের স্থানীয় প্রতিনিধি জসিম পারভেজ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের বরিশাল অঞ্চলের সভাপতি মং চোথিন তালুকদার, ছ-আনী পাড়ার উচ্ছেদের শিকার ও শিক্ষানবিস নারী আইনজীবি লাখাইন রাখাইন প্রমুখ।