হিল ভয়েস, ২৭ জুন ২০২৩, রাঙামাটি: রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩২নং বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের অন্তর্গত উগলছড়ি মুখ বটতলা মাঠে “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজ অধিকতর সামিল হউন” শ্লোগানকে সামনে রেখে ’শহীদ সমর, সুকেশ, মনতোষ ও রুপম চাকমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৩’- এর পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠানটি টুর্নামেন্টের আহ্বায়ক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ বাঘাইছড়ি থানা শাখার সভাপতি পিয়েল চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাঘাইছড়ির উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুমিতা চাকমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখার সভাপতি প্রভাত কুমার চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সদস্য বীর কুমার চাকমা, কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা। এছাড়াও বাঘাইছড়ি উপজেলার চার ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বিভিন্ন গণ্যমান্য নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুমিতা চাকমা বলেন, ‘শহীদ রূপম, সুকেশ, সমর বিজয় ও মনতোষ চাকমা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন এবং লড়তে লড়তে নিজেদের তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছেন। তাঁদের সেই সাহসী আত্মবলিদান কখনো বৃথা যাবে না, বৃথা যেতে পারে না।’
তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্র পাহাড়ের মানুষের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে এবং পাহাড়ি–বাঙালিদের মধ্যে বিভেদের বীজ রোপণ করে পাহাড়কে অশান্ত রাখার নিয়ত প্রয়াস চালাচ্ছে। যা আদৌ কারোর জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাষ্ট্রের উচিত পাহাড়ের মানুষকে কাছে টেনে নেওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। কারণ এই চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখার সভাপতি প্রভাত কুমার চাকমা বলেন, শহীদ সমর বিজয়, সুকেশ, মনতোষ ও রূপম চাকমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে নয়, এই টুর্নামেন্টের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ বাঘাইছড়ি থানা শাখা জুম্ম তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে কল্পনা চাকমার অপহরণ এবং পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া দগদগে কাহিনী ও কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা দুর্বার আন্দোলনে শহীদ সমর বিজয়, সুকেশ, মনতোষ ও রূপম চাকমার নির্মম ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আমি আশাবাদী, তারা ভবিষ্যতেও বাঘাইছড়িতে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
আক্ষেপের সুরে তিনি আরো বলেন, আমরা অনেকে হাজারো আশা, স্বপ্ন নিয়ে সেইদিন ৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এই অসহনীয়, যন্ত্রণাদায়ক জঙ্গলের জীবন থেকে আমরা স্থায়ী মুক্তি পেতে যাচ্ছি; অন্তত আমরা নিরাপদে বাকী জীবনটা সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু আজকে সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দীর্ঘ ২৫টি বছর পার হয়ে গেলো এবং সেটি শুধুমাত্র স্বপ্নই থেকে গেছে।
এছাড়া তিনি আরো বলেন, বর্তমান জুম্ম তরুণ ও যুব সমাজকে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য বাকী গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাত আনুমানিক ১:৩০ টায় আমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল আমার ছোট বোন কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যান। সেই অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদ এবং বিচার চাইতে গিয়ে রুপম চাকমাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অবরোধ মিছিলে যোগ দিতে আসা তিন টগবগে যুবক ও জুম্ম ভাই সুকেশ, সমর ও মনতোষ চাকমাকে মুসলিম ব্লক পাড়ার একেবারেই রাস্তার মাঝখানে সেটেলার বাঙালিরা কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা ও লাশ গুম করে।
তিনি দেশের বিচারব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, আজকে সেই আমার ছোট বোন কল্পনা চাকমার অপহরণ এবং অপহরণের প্রতিবাদে নির্মমভাবে শহীদ হওয়া এবং গুম হওয়া সুকেশ, মনতোষ, সমর বিজয় ও রূপম চাকমার ২৭ টি বছর পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত তার কোনো সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ন্যায় বিচার মেলেনি। বিচারহীনতা সংস্কৃতির জটিল রোগে আক্রান্ত এই রাষ্ট্রের কাছে আমার বোনের অপহরণের বিচার এবং সুকেশ, মনতোষ, সমর বিজয় ও রূপম চাকমাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাঁদের লাশ গুম করার বিচার চাইতে আর ইচ্ছে করে না।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সদস্য বীর কুমার চাকমা, খেদারমারা, বাঘাইছড়ি ও মারিশ্যা ইউনিয়নের তিন ইউপি চেয়ারম্যান সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
পরে ‘শহীদ সমর, সুকেশ, মনতোষ ও রূপম চাকমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৩’-এর চ্যাম্পিয়ন দল মারিশ্যা ইউনিয়ন, রানার্সআপ বাঘাইছড়ি ইউনিয়নসহ অপর দুই ইউনিয়নের দলকে পুরস্কার বিতরণ করে সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে চার শহীদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।