শ্রীদেবী তঞ্চঙ্গ্যা
১২ জুন ২০২৩ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ১৯৯৬ সালে দিবাগত রাতে নিজ বাড়ি থেকে অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে অপহরণ করা হয়। কল্পনা চাকমা ছিলেন পাহাড়ের ছাত্রী সমাজের অন্যতম লড়াকু সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। কল্পনা চাকমার বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনায়। গ্রামের পার্শ্ববর্তী তথাকথিত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কজইছড়ি সেনাক্যাম্প। তারা নানা অজুহাতে জুম্ম জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় নিপীড়নের স্টীম রোলার। এ সমস্ত নির্যাতন, নিপীড়নের প্রতিবাদ করতেন কল্পনা চাকমা। তাই কল্পনা চাকমার প্রতিবাদী কন্ঠকে চিরতরে স্তদ্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তাকে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সেনা সদস্য কর্তৃক অপহরণ করা হয়। এ সময় অপহরণকারীরা কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। কল্পনার দুই ভাই টর্চের আলোতে স্পষ্টতই অপহরণকারীদের মধ্য থেকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে: ফেরদৌস (মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মো: নুরুল হক ও মো: সালেহ আহমদকে চিনতে পারেন।
কল্পনা চাকমা আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ জুম্ম সমাজে নিম্নবিত্ত পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজনীতি সচেতন একজন তরুণী। স্বজাতির অধিকার ও নারী-পরুষের সমধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী এবং নিবেদিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিতে পদচারণা। অপহৃত হওয়ার সময়কালে তিনি ছিলেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কাচালং কলেজের বি এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার বয়স বড়জোর ২৩ বছর। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখনই কোনো নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যাকান্ড হতো তখনই তিনি এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হতেন। এমনকি এজন্য তিনি শাসক কর্মকর্তাদের সাথেও তর্ক করতেন এবং যুক্তি তুলে ধরতেন। পশ্চাৎপদ সমাজের ও আদিবাসী জুম্ম সমাজের নারী হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের জন্য তার যে লড়াই, সেটাই হয়েছে তার অপরাধ। এজন্যই তৎকালীন জাত্যাভিমানী, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভূ লেঃ ফেরদৌসরা মানবতা ও শিক্ষার মর্যাদার চরম পরিহানি ঘটিয়ে ঘুমন্ত কল্পনা চাকমাকে তুলে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
শাসকগোষ্ঠী এক কল্পনা চাকমার জীবন কেড়ে নিলেও এ পাহাড়ে আরও শত কল্পনা জন্ম নেবে। কল্পনা চাকমার জীবন কেড়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কল্পনার সংগ্রামী কন্ঠকে রুদ্ধ করা গেলেও হাজার কল্পনার কন্ঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রকম্পিত হয়েছে। কল্পনার কন্ঠের প্রতিধ্বনি সুদূর রাজধানীর রাজপথ কাঁপিয়েছে।
শাসকগোষ্ঠী কল্পনা চাকমাকে ছলে বলে কৌশলে আন্দোলন থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা চালায়। তাকে নানাভাবে হুমকি প্রদর্শন করা হয়, কিন্তুু কল্পনা চাকমা এইসব হুংকারে ভীত হয়ে সংগ্রাম থেকে সরে আসেননি।
কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ সহ আন্দোলন শুরু হয়। ২৭ জুন ১৯৯৬ এ নিয়ে বাঘাইছড়িতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে শান্তিপূর্ণভাবে অর্ধদিবস হরতাল পালনকালে বাঙালি সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় গুলি করা হয় রূপম চাকমাকে এবং নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সুকেশ, মনতোষ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমাকে। তাদের এই রক্ত বৃথা যেতে পারে না।
কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। ছাত্র থেকে শুরু করে লেখক, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সবাই কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ফলে সপ্তম জাতীয় সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। সাবেক বিচারপতি আব্দুল জলিল একজন সৎ বিচারপতি ছিলেন। এ জন্য তিনি কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রকৃত সত্যতা খুজঁতে ১৯৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন চাপে সত্যটা প্রকাশ করতে পারেননি। তবে জলিল কমিশনের একটা বক্তব্য ছিল, স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন, তবে কার দ্বারা অপহৃত হয়েছেন সেটি তিনি বলে যাননি।
অপহরণ ঘটনার পরপরই কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার অভিযোগ স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর বাদীর নারাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এরপর আদালতের নির্দেশে একে একে চট্টগ্রাম জোন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কয়েকজন পুলিশ সুপার রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একের পর এক ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা ও মামলার বিশ বছর ও পাঁচ মাসের অধিক সময় পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। এবিষয়ে আদালত ৮ জুন ২০১৭ প্রথম শুনানির আয়োজন করেন এবং নারাজির উপর পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে ক্রমাগত সময় চাইতে থাকেন। এ বিষয়ে আদালত সর্বশেষ আগামী ২৬ জুন ২০২৩ তারিখে শুনানির দিন ধার্য করেছেন বলে বাদীর সূত্রে জানা গেছে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে, এবারের শুনানিতেও অভিযুক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী বিচারের ব্যবস্থা নেয়া না হতেও পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং রাষ্ট্রের মালিক। সংবিধানে (২৭) এ বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আবার ২৮ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। কিন্তু, আজ ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও কল্পনা চাকমা অপহরণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশে রাষ্ট্র ও সরকার দুইই উদাসীন ও নীরব।
শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান এবং পার্বত্যবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেটেলার বাঙালি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কল্পনা চাকমা অপহরণের দীর্ঘ ২৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ২৭ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে পারেনি। যথাযথ বিচার করতে পারেনি মানবতা বিরোধী এই জঘন্য ঘটনার। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের বিচারহীনতার একটি হীন দৃষ্টান্ত। দেশের নারী সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা ও বঞ্চনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির এটি একটি জঘন্য পরিহাস! এটাই আঙুল দিয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দেয় যে, সামরিক যাঁতাকলে চরমভাবে পিষ্ট জুম্ম অধ্যুষিত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটাই প্রমাণ করে যে, শাসকগোষ্ঠী কতৃর্ক ভূমি বেদখল, জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণ, সর্বোপরি জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার জন্য জঘন্য হাতিয়ার হিসেবে জুম্ম নারীর উপর জঘন্য সহিংসতা, অপহরণ, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্যমতে, ২০২২ সালে ১২ জন জুম্ম নারীর উপর শারীরিক ও যৌন সহিংসতা ঘটনা ঘটেছে। বস্তুত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং চুক্তির আলোকে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ কার্যকর না হওয়ায়, উল্টো চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্র জোরদার হওয়ার কারণে চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও এহেন ঘটনা বেড়েই চলেছে।
তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে যথাযথভাবে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা হোক।
সর্বোপরি জুম্ম নারীর জাতিগত নিরাপত্তা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
কল্পনা চাকমার জীবন ও সংগ্রাম বৃথা যেতে পারে না।