হিল ভয়েস, ৪ মে ২০২৩, রাঙামাটি: আজ ৪ মে ২০২৩ সকাল ১০ টায় রাঙামাটি সদরে লংগদু গণহত্যার ৩৪ বছর ও শহীদদের স্মরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), রাঙামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপির রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন টিকেল চাকমা। এতে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি অমিতাভ তঞ্চঙ্গা। এছাড়া বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক চারুলতা তঞ্চঙ্গা, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মিন্টু চাকমা। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রনেল চাকমা।
আলোচনা সভার শুরুতে লংগদু গণহত্যায় শহীদদের উদ্দেশ্যে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় এবং এরপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে অমিতাভ তঞ্চঙ্গা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে লংগদু গণহত্যা একমাত্র গণহত্যা নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো ডজনখানেক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এই গণহত্যাগুলো সংগঠিত করার প্রধান ও অন্যতম কারণ, জুম্ম জনগণের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দেওয়া। শাসকগোষ্ঠীর সেই ষড়যন্ত্র তৎকালীন জুম্ম ছাত্র সমাজ মেনে নেয়নি। সেনা শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, জুম্ম ছাত্র সমাজ সেবার ঢাকায় সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদী অবস্থান নিয়েছিল, সেখান থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র-তরুণদের কান্ডারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জন্মলাভ করে।
তিনি আরো বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভাগ্যাকাশে কালো অধ্যায় নেমে এসেছিল। পর্যায়ক্রমে শাসকগোষ্ঠীর নির্মম দমন-পীড়নের শিকার হয় জুম্ম জনগণ। ষাট দশকের কাপ্তাই বাঁধের ফলে জুম্ম জনগণকে তাদের বাসভূমি থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার যে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ছিল সেটা বলাবাহুল্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জুম্ম জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে বিমাতাসূলভ আচরণ, জুম্ম জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের মধ্যে দিয়ে যে কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী সেটা রাষ্ট্রকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে এবং অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, ১৯৮৯ এর ৪ঠা মে লংগদু ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অপরাপর গণহত্যাগুলো ছিল জুম্ম জনগণের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসী, উগ্র জাত্যভিমানী ও জাতিগত নির্মূলীকরণ চরিত্রের জ্বলন্ত উদাহরণ। কোনো জায়গায় জাতিগত, শ্রেণিগত ও বর্ণগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলে সেটাকে গণহত্যা বলে মেনে নেওয়া হয়। লংগদুতে যে হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করা হয়েছিল এটা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যেই ছিল তার প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় জুম্মদের জাতিগত অস্তিত্ব অস্বীকার করে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সেসময়ের রাষ্ট্র নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী চৌদ্দটি জাতিগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করে এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের এই উগ্র জাত্যভিমানী চরিত্র থেকে জুম্মদের উপর একের পর এক গণহত্যা, দমন-পীড়ন, ভূমি বেদখল, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার পুনর্বাসন, অবৈধ সেনাশাসন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ ইত্যাদি রাষ্ট্রের জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম এবং শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রকে পরিষ্কার করে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান তরুণ ছাত্র সমাজ যদি রাষ্ট্রের এই চরিত্রকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে পাহাড় একদিন জুম্ম জনগণ শূণ্য হয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্মের অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে কিছুই জানে না। অথচ চুক্তির জন্য কত রক্ত ঝরেছে, মা তার ছেলেকে, সন্তান তার বাবাকে, স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে। রক্তে গড়া এ চুক্তি বৃথা যেতে পারে না। তাই তরুণ সমাজকে সমগ্র পিছুটান ফেলে চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে আরো জোরালো ভাবে সামিল হতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের উপরই নির্ভর করছে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব।
চারুলতা তঞ্চঙ্গা বলেন, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে লংগদু গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জন্মলাভ করে। শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসন ও দমন-পীড়নকে প্রতিরোধ করতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তথা জুম্ম ছাত্র সমাজকে আরো জোরালোভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হলে ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মিন্টু চাকমা বলেন, লংগদু গণহত্যার পর তৎকালীন সচেতন ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তারা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ গঠন করে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে বর্বরোচিত এ গণহত্যার প্রতিবাদ জানায়।
তিনি আরো বলেন, লংগদু গণহত্যার ৩৪ বছর পরও বিচার মেলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত গণহত্যা অহরহ। লোগাং গণহত্যা, কাউখালী গণহত্যা, নানিয়ারচর গণহত্যার মতো নারকীয় তান্ডবের সাক্ষী জুম্ম জনগণ। তিনি জুম্ম ছাত্র সমাজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে আরো অধিকতরভাবে সামিল হওয়ার আহ্বন জানান।
সভাপতির বক্তব্যে পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমা বলেন, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে লংগদুতে সংঘঠিত ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যার শোককে শক্তিতে পরিণত করে জুম্ম ছাত্র সমাজ এক ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। বর্তমানে সেই লংগদু গণহত্যার ৩৪ বছর পেরোল। এই ৩৪ বছরের মধ্যে পাহাড়ে আরো অনেকগুলো গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। আরো অজ¯্র অমানবিক ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আজকের তরুণ ছাত্র সমাজকে নব্বইয়ের সেই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডোর টু ডোর, ম্যান টু ম্যান গিয়ে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে, জাতি গঠনে, দেশ গঠনে ছাত্র সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।