হিল ভয়েস, ১০ মে ২০২৩, বান্দরবান: সর্বশেষ বান্দরবান জেলাধীন রোয়াংছড়ি উপজেলার অধিবাসী আরও ৩ বম গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ নিয়ে বিগত প্রায় এক মাসের ব্যবধানে দুই দফায় রোয়াংছড়িতে সন্ত্রাসীদের কর্তৃক ১০ জন নিরীহ বম আদিবাসীকে হত্যা করা হল। ফলে ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকার জনগণের মধ্যে গভীর আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং আতঙ্কে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ মে ২০২৩ দুপুরের দিকে রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পাইক্ষ্যং পাড়ার রিজার্ভ এলাকায় সন্ত্রাসীরা ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই বম সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি নিহত হন এবং অপর একজন আহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন- নেমথাং বম (৪৩), পীং-দোখার বম; লাল লিয়ান বম (৩২), পীং-লিয়ান থম বম ও সিমলিয়ান থাং বম (৩০) এবং আহত ব্যক্তির নাম মানসার বম। নিহতদের সবাই রোয়াংছড়ির রোনিন পাড়া এলাকার বাসিন্দা এবং নিহতদের মধ্যে নেমথাং বম রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং লাল লিয়ান বম মোটর সাইকেল চালক বলে জানা গেছে। ঘটনার সময় উক্ত ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।
ঐ দিনই বিকালে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলিতে নিহত ৩ জনের লাশ উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং পরদিন (৯ মে) হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ বম সোস্যাল কাউন্সিলের নিকট লাশগুলো হস্তান্তর করে।
জানা গেছে, ভয়ে-আতঙ্কে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন লাশ গ্রহণ করতে যায়নি। ফলে পুলিশের কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করেন বম সোস্যাল কাউন্সিলের নেতা লালজার বম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরাই এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা জানান, ঐদিনই সকালের দিকে পাইক্ষ্যং পাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের একটি সশস্ত্র দল অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা রোনিন পাড়া থেকে রোয়াংছড়ি বাজারের দিকে আসা বম গ্রামবাসীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে।
এদিকে, বারবার নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর এধরনের সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকান্ড এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কর্তৃক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এলাকার জনগণের মধ্যে গভীর আতঙ্ক ও উদ্বেগ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। উক্ত ঘটনার পর ইতোমধ্যে অনেকে নিজেদের বাড়িঘর ও গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
উক্ত তিন হত্যাকান্ডের পর পাইংখিয়ংপাড়া, ক্যাপলংপাড়া, রৌনিনপাড়া, জুরভারংপাড়াসহ বিভিন্ন বমপাড়ার পুরুষ সদস্যরা অনেকেই আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে জঙ্গলেও আশ্রয় নিয়েছেন।
জানা গেছে, অনেকে বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ দীর্ঘ দিন ধরে আতঙ্কে কাজের জন্য বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে পরিবারে আয়-উপার্জন হ্রাস পেয়েছে এবং অভাব-অনটন বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লেখ্য যে, গত ৭ এপ্রিল ২০২৩ রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের খামতাং পাড়ায় সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কর্তৃক ৭ জন নিরীহ বম গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং একইদিন সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী এবং বম পার্টি সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে বম পার্টির এক সদস্য নিহত হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৬ এপ্রিল ২০২৩ সকাল ৬:৩০ টার দিকে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর ২০-২৫ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী খামতাং পাড়ায় প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পাড়াবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরে সন্ত্রাসীরা একে একে পাড়ার ২২ জনকে আটক করে রাখে।
পরে আটককৃত ২২ জনের মধ্য থেকে ১৫ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে অপর ৭ জনকে খামতাং পাড়া প্রাইমারি স্কুলে আটক করে রাখে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা। পরদিন ভোর রাতে বম পার্টি সন্ত্রাসীদের একটি দল সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের দুই দফা সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে উভয়পক্ষের গুলি বিনিময় হলে বম পার্টির এক সদস্য নিহত হয়।
অপরদিকে বম পার্টির দ্বিতীয় বারের হামলায় সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা রাগান্বিত হয়ে আটককৃত ৭ জন নিরীহ বম গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে বলে সূত্রে জানা যায়।
উক্ত ঘটনার পর ভয়ে-আতঙ্কে জীবন বাঁচাতে নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে খামতাং পাড়া, পাইক্ষ্যং পাড়া ও ক্যপ্লং পাড়ার ২৫০ এর অধিকার বম ও মারমা সম্প্রদায়ের পরিবার রুমা সদরের বম সোশ্যাল কাউন্সিল হলরুমে এবং রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩ বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সন্ত্রাসীদের কর্তৃক রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের মোলপি পাড়া থেকে দুই মারমা গ্রামবাসীকে অপহরণ করে ব্যাপক মারধর করার পর ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ছেড়ে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী ও সরকারি মহলই জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জোরদারকরণসহ অধিকারকর্মীদের অপরাধীকরণ, দমন-পীড়ন এবং চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একের পর এক ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), জেএসএস (সংস্কারপন্থী), মগ পার্টি, বম পার্টি ইত্যাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও ব্যবহার করে থাকে।
কিন্তু ২০২১ সাল হতে একটি চুক্তি মোতাবেক বমপার্টি অর্থের বিনিময়ে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া নামক একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করলে এবং পরে সে খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসলে অন্যান্য বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীও বম পার্টির বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কম্বিং অপারেশনের প্রায় এক বছরেও বম পার্টির বিরুদ্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য সফল অভিযান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে সম্প্রতি সেনাবাহিনী বম পার্টির বিরুদ্ধে ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীদের নিয়োজিত করে।
এদিকে, সন্ত্রাসীরা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ সাধারণ জনগণ হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং চরম আতঙ্ক ও অচলাবস্থার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আদিবাসী অধিকারকর্মী।