মংকিউ মারমা
প্রক্সি যুদ্ধ বলতে মূলত দু’টি দেশ বা দু’টি পক্ষের মধ্যে সহিংস লড়াই যাতে কোনো পক্ষ সংঘাতে সরাসরি যুক্ত না থেকে তৃতীয় কোনো পক্ষকে ব্যবহার করে যুদ্ধ করা বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে বুঝায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে তথা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠন ও জনগণের বিরুদ্ধে সেই ধরনের প্রক্সি যুদ্ধ বা ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। সেনাবাহিনীর এই প্রক্সি যুদ্ধে গোড়া থেকেই প্রসিত-রবিশঙ্করের ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, বমপার্টি ইত্যাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর ভাড়াতে বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সেনাবাহিনীসহ তিন বাহিনীর সম্মতি সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীদের রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হলেও চুক্তির পর সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশ সরকার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। ফলে পার্বত্য চুক্তির অনেক বিষয় বাস্তবায়িত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ, বিশেষ করে, স্বশাসন সংক্রান্ত বিধানাবলী বাস্তবায়ন থেকে সরকার সুকৌশলে বিরত থাকে। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনসার্জেন্সীর অবসান হলেও শেখ হাসিনা সরকার ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাশাসন জারি করে সেনাবাহিনীর হাতে পার্বত্য চট্টগ্রাামকে তুলে দিয়েছিল। উক্ত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা, উন্নয়নসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
সরকার কেবল চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেনি, সেই সাথে পার্বত্য চুক্তিকে পদদলিত করে সেনাবাহিনী তথা সরকার একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র হাতে নিতে থাকে এবং সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্র কাজে লাগিয়ে চারিদিকে ঘিরে ধরার মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একদিকে জুম্ম জনগণের মধ্য থেকে সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, উচ্ছৃঙ্খল ও তাঁবেদার ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সেসব গোষ্ঠীকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তথা জনসংহতি সমিতিসহ চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া; এবং অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামে একক সংগঠনে বাঙালি মুসলিম সেটেলারদের সংগঠিত করে এবং মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীদের উস্কে দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন দেশের সংঘাত-প্রবণ এলাকায় শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেই একই সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্মদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও এতদাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে, যা ইতিমধ্যে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামসহ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে। তারই আলোকে ২০০০ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের অধীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে এবং ২০১১ সালে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের ১০তম অধিবেশনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের পূর্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার রেকর্ড যাচাই করার সুপারিশ করা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় এবং সর্বোপরি তাদের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকা যাতে উন্মোচিত না হয়, সেজন্য জুম্ম জনগণের মধ্য থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে এবং নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সেনাবাহিনী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে তথা এই আন্দোলনে নেতৃত্বপ্রদানকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে নিয়োজিত করতে থাকে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে না হতেই প্রসিত ও রবিশঙ্করের নেতৃত্বে সৃষ্ট ইউপিডিএফ’কে প্রথমে এই প্রক্সি যুদ্ধে নিয়োজিত করে সেনাবাহিনী তথা সরকার। সেই সময় সশস্ত্র ইউপিডিএফ সদস্যদেরকে বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প সংলগ্ন জায়গায় আশ্রয় দেয়া হয় এবং জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ চুক্তি সমর্থক ব্যক্তিদের অবাধে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে সুযোগ করে দেয়া হয়। নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র অবস্থায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের ঘোরাফেরা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হতো না। এমন দিন যায় না, যেদিন ইউপিডিএফ কর্তৃক জনসংহতি সমিতির কোনো না কোনো সদস্য ও সমর্থকদের বাড়িতে হামলা করা হয়নি কিংবা অপহরণ করা হয়নি। সেসময় সেনাবাহিনী তথা সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ইউপিডিএফ কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাগত জনসংহতি সমিতির শতাধিক সদস্যসহ তিন শতাধিক চুক্তি সমর্থককে হত্যা করে।
অপরদিকে সেনাবাহিনী অপপ্রচার চালাতে থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা হুমকির মধ্যে পড়বে মর্মে দেশে-বিদেশে প্রচার করতে থাকে। সেই সাথে এই প্রক্সি যুদ্ধকে জুম্ম জনগণের মধ্যে আভ্যন্তরীণ হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত মর্মে প্রচার করে সেনাবাহিনী নিজেদের অপকর্মের দায় জুম্ম জনগণের উপর, বিশেষ করে, জনসংহতি সমিতির উপর চাপাতে থাকে। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রক্সি যুদ্ধে উস্কে দিয়ে সেনাবাহিনী তথা সরকার তাদের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাতে থাকে।
২০০৬ সালে দেশে জরুরী অবস্থা জারি হলে ১/১১-এর পর সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেয়া প্রক্সি যুদ্ধের নতুন মাত্রা লাভ করে। রাজনৈতিক সংস্কারের ধোঁয়া তুলে সেনাবাহিনী সারাদেশে যেমন ‘মাইনাস টু’ (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মাইনাস করা) ফর্মূলা প্রয়োগ করতে থাকে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় ‘মাইনাস ওয়ান’ (সন্তু লারমাকে মাইনাস করা) ফর্মূলা প্রয়োগ করতে থাকে। একদিকে বিভিন্ন মামলায় জড়িত করে জেল-জুলুমের ভয়ভীতি প্রদর্শন, অন্যদিকে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারের পদ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে জনসংহতি সমিতির কতিপয় আদর্শচ্যুত, ক্ষমতালিপ্সু ও সুবিধাবাদী সদস্যদের জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার বিরুদ্ধে উস্কে দিতে থাকে এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে উপদলীয় চক্রান্তের ইন্ধন দিতে থাকে। ফলে একপর্যায়ে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর মদদে ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাতিন্দ্র-সুধাসিন্ধু-রূপায়নের নেতৃত্বে সংস্কারপন্থী জেএসএস নামে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গঠিত হয়।
জরুরী অবস্থার সুযোগে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে তখন সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপকে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলায় মোতায়েন করা হয়। তখন তিন পার্বত্য জেলায় কতিপয় এলাকায় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জেরে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থী এই দুই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে লিপ্ত জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে থাকে। সেসময় সেনাবাহিনীর মদদে ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীদের প্রক্সি যুদ্ধের ফলে তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসের কাছে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার কতিপয় এলাকায় সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউপিডিএফ কর্তৃক লংগদুর কাট্টলী হ্রদ এলাকা থেকে জনসংহতি সমিতির ৬২ জনকে গণঅপহরণের ঘটনা, যা জুম্ম জনগণকে হতবাক করেছিল।
এক পর্যায়ে ২০১৪ সালের দিকে সেনাবাহিনীর উস্কে দেয়া প্রক্সি যুদ্ধ থেকে সরে এসে জুম্ম জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীদের আহ্বান জানানো হয় জনসংহতি সমিতির তরফ থেকে। জনসংহতি সমিতির আহ্বানে সেসময় ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীরা এগিয়ে এলে উভয় পক্ষের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বেশ কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেয়া প্রক্সি যুদ্ধ স্তিমিত হয়ে আসে এবং অধিকারকামী সাধারণ জুম্ম জনগণ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।
তবে প্রক্সি যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় সেনাবাহিনীর ঘুম হারাম হয়ে পড়ে। কিভাবে আরো নতুন করে সেই প্রক্সি যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া যায় তা নিয়ে সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী সংস্কারপন্থী নেতা তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়। তাতিন্দ্র লালকে দিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ থেকে নিষ্ক্রিয় ও বহিষ্কৃত সদস্যদের নিয়ে তপন জ্যোতি চাকমা ও শ্যামল কান্তি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে সেনা-মদদপুষ্ট আরেকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করা হয়। তখন থেকে আবার নতুন করে সেনাবাহিনীর প্রক্সি যুদ্ধ জোরদার হয়ে উঠে। ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী ত্রিমুখী প্রক্সি যুদ্ধের শুরুতেই ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা এবং সংস্কারপন্থীদের অন্যতম হোতা নান্যাচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাসহ পর পর দুই দিনে ৭ জন নিহত হন। জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে বন্ধ হওয়া সেনাবাহিনীর প্রক্সি যুদ্ধ এভাবে নতুন মাত্রায় আবার জ্বলে উঠতে থাকে। একপর্যায়ে খাগড়াছড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় প্রসিত-রবিশঙ্করের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ কর্তৃক বাধা দেয়ায় এই গ্রুপটি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ থেকে ছিটকে পড়ে। এরপর সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সন্ত্রাসী দৌরাত্ম্য সেনাবাহিনীর নানামুখী সহায়তায় ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জনসংহতি সমিতির সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়কে রোধ করার জন্য সেনাবাহিনীর মদদে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ কর্তৃক বিদেশী সশস্ত্র গোষ্ঠী “আরাকান লিবারেশন পার্টি” (এএলপি)-এর দলছুট উচ্ছৃঙ্খল ও বহিষ্কৃত সদস্যদের নিয়ে গঠিত মগপার্টি নামে খ্যাত মারমা লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে বান্দরবান সদর ও রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে এনে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলায় মোতায়েন করা হয়। সেই মগপার্টিকে দিয়ে সেনাবাহিনী রাজস্থলী, কাপ্তাই, বান্দরবান সদর ও রোয়াংছড়ি এলাকায় প্রক্সি যুদ্ধের গোড়া পত্তন করে, যা আজো চলমান রয়েছে। মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের পোয়াইতু পাড়ার সরকারি স্কুলে মোতায়েন করে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে সেই স্কুলে মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়। সেনাবাহিনী কর্তৃক মগপার্টি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদানের অন্যতম প্রকাশ্য ঘটনা হলো বান্দরবান সেনা ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মগপার্টির ২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে বান্দরবান শহরের উজানী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা। মগপার্টির সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর মদদে এ যাবৎ জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ কমপক্ষে ৪০ জন নিরীহ লোক হত্যা করেছে।
প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর জন্য সেনাবাহিনীর মদদে সর্বশেষ গঠিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হলো বমপার্টি নামে খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ২০০৮ সালে তৎকালীন বান্দরবান ব্রিগেড কম্যান্ডারের উদ্যোগে নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান বমের নেতৃত্বে প্রথমে কুকি-চিন ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে সংগঠন গঠন করা হয়। পরে ২০১৬ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং এই সংগঠনকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতায় লেলিয়ে দেয়া হয়। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ৯টি উপজেলাকে নিয়ে কুকি-চিন ষ্টেট গঠনের দাবি করা হলেও বমপার্টির মূল উদ্দেশ্য হলো সেনাবাহিনীর এজেন্ডা অনুসারে পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস করা। এজন্য গোড়া থেকেই এই বমপার্টি পার্বত্য চুক্তিকে ‘চাকমা চুক্তি’, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ‘চাকমা পরিষদ’ এবং জনসংহতি সমিতিকে ‘চাকমা পাটি’ নামে অভিহিত করতে থাকে। সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করতে না করতেই বমপার্টি রোয়াংছড়ি ও রুমা থেকে জনসংহতি সমিতির সমর্থক গ্রামবাসীদের উপর সশস্ত্র হামলা ও উচ্ছেদ করতে উঠে পড়ে লাগে। এভাবেই বমপার্টিকে লেলিয়ে দিয়ে রুমা-রোয়াংছড়ি এলাকায় সেনাবাহিনী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধের পত্তন ঘটায়।
সেনাবাহিনীর মদদে বমপার্টি কর্তৃক নিরীহ গ্রামবাসীর উপর হামলার অন্যতম নৃশংস ঘটনা হলো ২০২২ সালের জুন মাসে বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ, যেখানে তিন জন নিহত ও ২ শিশু আহত হয়। এর পর পরই বমপার্টি বিলাইছড়ি ও রোয়াংছড়ি থেকে পার্বত্য চুক্তি সমর্থক তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে একশত পরিবারকে উচ্ছেদ করে।
এরপর ২০২০ সালে বমপার্টি অর্থের বিনিময়ে রুমার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের সিলৌপি পাড়া সংলগ্ন গহীন পাহাড়ে স্থাপিত তাদের কেটিসি ক্যাম্পে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া নামক একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। সেই চুক্তি মোতাবেক ২০২১ সাল থেকে বমপার্টি সেই ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে থাকে, যা সেনাবাহিনী দেখেও না দেখার ভান করে প্রকারান্তরে মদদ দিতে থাকে। পরে ঘটনাটি গণমাধ্যমে উঠে আসলে সেনাবাহিনী তথা সরকার উক্ত ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ও জঙ্গীদের আশ্রয়প্রদানকারী কেএনএফের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন চালাতে বাধ্য হয়।
কম্বিং অপারেশনের প্রারম্ভিক অবস্থায় রোয়াংছড়ির সিপ্পি পাহাড়ের আস্তানায় সেনাবাহিনী কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীদের ঘিরে রাখলেও সেখান থেকে কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীদের পালিয়ে যেতে কৌশলে সুযোগ করে দিয়েছিল। কম্বিং অপারেশনের ফলে অনেক ইসলামী জঙ্গী পাহাড় থেকে সমতল অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনী, র্যাব ও সিটিটিসি’র হাতে ধরা পড়লেও এখনো কেএনএফ ও জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার নেতারা ধরাছোঁড়ার বাইরে রয়েছে। জানা যায় যে, রুমার সিলৌপি পাড়া সংলগ্ন কেএনএফের কেটিসি ক্যাম্পে এখনো ‘জামায়াতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র নেতৃবৃন্দসহ ডজন খানেক জঙ্গী সদস্য অবস্থান করছে। বমপার্টি এখনো ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম থেকে সরে আসেনি বলে জানা যায়।
সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ থেকে ছিটকে পড়া ইউপিডিএফ সম্প্রতি ২০২০ সাল থেকে আবার নতুন করে সেনাবাহিনীর সাথে গাঁটছড়া বাধার প্রক্রিয়া শুরু করে। তার আলোকে গত ২৭ এপ্রিল ২০২১ উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা ও সচিব চাকমা’র নেতৃত্বে ইউপিডিএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি ব্রিগেডে সেনাবাহিনীর সাথে একটি গোপন বৈঠকে বসে। এরপর সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক নতুন করে জোরদার হয়ে উঠে। এরপর ৯ জুন ২০২২ ইউপিডিএফ সরকারের নিকট পেশ করার জন্য মধ্যস্থতাকারীর কাছে দাখিলকৃত তথাকথিত দাবিনামা পেশ করে। এর পরই সেনাবাহিনীর মদদে ১১ জুন ২০২২ ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্যরা পার্বত্য চুক্তি পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের উপর সশস্ত্র হামলা শুরু করে। এভাবেই ইউপিডিএফ’কে দিয়ে সেনাবাহিনী কাচালং ও মাইনী রিজার্ভে ও পানছড়ি এলাকায় আবার নতুন করে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে, যা এখনো চলমান রয়েছে।
বস্তুত সরকারের প্রশ্রয়ে এভাবে সেনাবাহিনী একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে সন্ত্রাসী দমনের নামে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার দায়ভার সমিতির উপর চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। গত ২৬ মে ২০২২ রাঙ্গামাটিতে এপিবিএনের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র তৎপরতার মনগড়া অভিযোগ এনে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে সম্মুখ যুদ্ধের আহ্বান জানান এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি প্রদান করেন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন।
গত ৬ এপ্রিল ২০২৩ সেনাবাহিনীর মদদে রোয়াংছড়ির খামতাং পাড়ায় সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) কর্তৃক একজন বমপার্টির সদস্যসহ ৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। বান্দরবান ব্রিগেড ও রুমা জোনের সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৃষ্ট কেএনএফের প্রতি সেনাবাহিনীর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে বমপার্টির বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান প্রায়ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীদের নিয়োজিত করে। ফলে সেনাবাহিনীর নির্দেশেই এই নৃশংস ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে এবং এ ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীই পুরোপুরি দায়ী। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রচার করে যে, দুই সশস্ত্র গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে এই ৮ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে।
বস্তুত পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাত কখনোই জুম্মদের মধ্যকার সংঘাত নয়, এটা সেনাবাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে লেলিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী তথা সরকারই এই প্রক্সি সংঘাত সংঘটিত করছে এবং এজন্য সেনাবাহিনী তথা সরকারই পুরোপুরি দায়ী। এক্ষেত্রে আপামর জুম্ম জনগণ তথা চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে লিপ্ত জনসংহতি সমিতি দায়ী নয়। সেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক সংঘটিত হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য পুরোপুরি সেনাবাহিনীই তথা সরকারই দায়ী। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতার দায় ধামাচাপা দিয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীই এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত করে চলেছে।
শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগসহ জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে যুক্ত জুম্মদের সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু ও তাঁবেদার লোকদেরকে মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনী সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও উত্তেজনা নিরসনের পরিবর্তে বর্তমানে সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক প্ররোচনা আরো জোরদার করেছে। তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামক একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনে সংগঠিত করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি তৎপরতায় লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আহূত সভা ভন্ডুল করার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কর্তৃক ৩৬ ঘন্টার হরতাল আহ্বান। এ সময় প্রশাসন, নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মুসলিম সেটেলারদের হরতাল প্রতিরোধ করার পরিবর্তে প্রকারান্তরে হরতালকারীদের সহায়তা করতে দেখা গিয়েছিল। চুক্তি-উত্তর সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্ম জনগণের উপর ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ২০১৪ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো ব্যাপক সামরিকায়ন করে দমন-পীড়নের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় সমাধানের নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এর ফলে চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অধিকতর জটিল ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে সেনাবাহিনী তথা সরকার ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘চাঁদাবাজি’ কার্যক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করে ক্রিমিনালাইজ করে চলেছে। ফলে জুম্ম জনগণের জীবনে নির্বিচারে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ, জামিনে মুক্তির পর জেল গেইট পুন:গ্রেফতার, ক্রসফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাসী ও হয়রানি, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি প্রক্সি যুদ্ধে দুই যুযুধান পক্ষ ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক থাকে। আর এই সম্পর্কগুলি সাধারণত আর্থিক, সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতার রূপ নেয় ও যুদ্ধ সচল রাখে। ঠিক সেভাবে সেনাবাহিনীও সংস্কারপন্থী, দুই ইউপিডিএফ ফ্যাকশন, মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আর্থিক ও অন্যান্য লজিষ্টিক সহায়তা দিয়ে চলেছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রক্সি যুদ্ধ অব্যাহত রাখছে। রুমা ও রোয়াংছড়িতে বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী-ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও এভাবে আর্থিক ও লজিষ্টিক সাপোর্ট দিয়ে সেনাবাহিনী প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্কারপন্থী, দুই ইউপিডিএফ ফ্যাকশন, মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও সেনাবাহিনীর ভাড়াতে বাহিনী হিসেবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ জারি রেখেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর এই প্রক্সি যুদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে সাময়িক ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে বটে, তবে চূড়ান্তভাবে এই প্রক্সি যুদ্ধ সেনাবাহিনী তথা সরকারের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য। ইতিমধ্যে বমপার্টি সেনাবাহিনী তথা সরকারের জন্য বুমেরাং ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। তাই এই সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে ও জাতীয় উদ্যোগে সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। একটা রাজনৈতিক সমস্যা কখনোই সামরিক উপায়ে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান হতে পারে না। তাই এক্ষেত্রে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধানের নীতি পরিহার করে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ, পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে সেনাবাহিনী তথা সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নি:সন্দেহে শুভ ফল বয়ে আনবে তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।