হিল ভয়েস, ৩০ মে ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী মোতায়েন প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান, যাতে আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের সাধারণ জনগনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া যায়। গত ২৫শে মে ২০২৩ ছয় কংগ্রেসম্যান এই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। উক্ত ছয় কংগ্রেসম্যান হলেন, স্কট পেরি, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন, বব গুড, টিম ওয়ালবার্গ এবং কিথ সেলফ।
জো বাইডেনকে লেখা ছয় কংগ্রেসমযানের চিঠিটি নিম্নরূপ:
“আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য এবং বাংলাদেশের জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সর্বোত্তম সুযোগ দেওয়ার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।
শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রিডম হাউস, এমনকি জাতিসংঘের রিপোর্ট সহ বিভিন্ন এনজিও সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শত শত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যাতে উল্লেখ করা হয়, হাসিনার সরকার কর্তৃক ক্রমবর্ধমানভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া জনগণকে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সাংবাদিকদের জেল, বিরোধীদের জোরপূর্বক গুম এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের লাঞ্ছিত করা বা হত্যা করা হয়েছে।
হাসিনা সরকারের এই সমস্ত তথ্য সমৃদ্ধ কুকীর্তি কেবল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সরকার বাংলাদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও নির্যাতন চালিয়েছে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের হিন্দু জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে, লুটপাট ও বাড়িঘর পোড়ানো, মন্দির ও ধর্মীয় মূর্তি ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ এবং ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি হিন্দুদের দেশান্তরকরণে বাধ্য করছে। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর ওপরও নির্যাতন চালিয়েছে। ধর্মীয় উস্কানিতে উপাসনালয় পুড়িয়ে দেওয়া ও লুটপাট করা, যাজকদের জেলে পাঠানো এবং বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাসিনা সরকারের পরিবর্তনের আশায় হাজার হাজার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য বিক্ষোভ করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের মূল হোতা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এমনকি হত্যার মত ঘটনা ঘটিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অসংখ্য এনজিও দ্বারা র্যাবকে একটি সরকারি ডেথ স্কোয়াড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী ডয়েচে ভ্যালী এবং সুইডেন ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা নেত্র নিউজের সাম্প্রতিক তদন্তে র্যাবের দুইজন সাবেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, বিচার-বহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড এবং বলপূর্বক গুমের ঘটনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া সম্ভব ছিল না।
মার্কিন সরকার এক বছরেরও বেশি সময় আগে র্যাবকে “গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী” হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং র্যাবের পাশাপাশি দেশের অপরাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদেরকেও অনেক হত্যা ও অন্যান্য নৃশংসতার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তারপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে হাসিনা সরকার বাংলাদেশের জনগণের ওপর কৌশলগতভাবে দমন-পীড়ন আরো জোরদার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে হ্রাস করতে এবং গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারে যথেষ্টভাবে কাজ করতে পারেনি।
নিজেদের জনগণের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের পাশাপাশি, হাসিনা সরকারের অসদাচরণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সহযোগিদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে উৎসাহিত করছে এবং চীন ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করছে, যা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা দৃঢ়ভাবে অনুরোধ করছি যে, যাতে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও কঠোর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সামরিক বাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।”
একটি ইউটিউব ভিডিওতে বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, শুধু তাই নয়, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ইইউ-এর চার্লস ওয়াটল বলেছেন, ২০২৯ সাল থেকে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে না। তবে জিএসপি প্লাস নামে একটি সুবিধা থাকবে। জিএসপি প্লাসে ৩২টি শর্ত রয়েছে, যার মধ্যে প্রথম ও প্রধানটি হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রীতি বিন্দু চাকমা বলেছেন যে, প্রেসিযেন্ট জো বাইডেনের কাছে পাঠানো চিঠিতে ছয়জন কংগ্রেসম্যান যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে- সামরিক বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চল। আদিবাসী জুম্ম জনগণ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর দ্বারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জুম্ম জনগণ নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের অধীনে রয়েছে।
শ্রী চাকমা আরও যোগ করেন যে, এই কারণে, জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিরা ২০০০ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের অধিবেশনে এবং ২০১১ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধীন জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফেরামের অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশন বিভাগকে আহ্বান জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম অধিবেশনে “জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিযুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় যাচাই করার” সুপারিশ গৃহীত হয় । সম্প্রতি ১৭-২৮ এপ্রিল ২০২৩ইং তারিখে অনুষ্ঠিত স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনেও জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিরা উল্লিখিত সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।