হিল ভয়েস, ১ এপ্রিল ২০২৩, রাঙ্গামাটি: সাজেক সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং সীমান্ত সড়কের পার্শ্ববর্তী নিজস্ব জায়গা-জমিতে জুম্মদেরকে ঘরবাড়ি নির্মাণে ও চলাচলে বাধা প্রদানের প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী।
গতকাল ৩১ মার্চ ২০২৩ দুপুরের দিকে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের উদয়পুর এলাকায় সাজেকের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর ব্যানারে এক বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
বিব্রকান্তি চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলোময় চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার মোহন লাল চাকমা, স্থানীয় গ্রামের কার্বারি বুদ্ধি রঞ্জন চাকমা, ললিত কার্বারি, উদয় রঞ্জন চাকমা প্রমুখ।
বাঘাইছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লিখিত স্মারকলিপিতে বলা হয়ঃ
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলার অন্যান্য এলাকার ন্যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার ১৬৮নং কংলাক মৌজা ও ১৬৭নং রুইলুই মৌজার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের উদয়পুর জংশন থেকে উত্তরে ১০ কিলোমিটার ও দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার সাজেক আন্তর্জাতিক সীমান্ত পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে।
অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও পরিতাপের বিষয় যে, সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় নেতৃত্ব ও অধিবাসীদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা ও পূর্ব সম্মতি ব্যতিরেকে এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর কোনরূপ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করেই সরকার ও সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সাজেকে বিজিবি কর্তৃক জুম্মদের বাড়ি নির্মাণে বাধা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে মানববন্ধন
উল্লেখ্য, উক্ত সড়ক নির্মাণের ফলে বিগত ২০২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত ২১০ জুম্ম পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে কয়েক শত জুম্ম পরিবার। বিশেষ করে, সড়ক নির্মাণ করার সময় জুম্মদের ঘরবাড়ি, দোকান এবং সেগুন, আগর, বাঁশ ইত্যাদি মূল্যবান বনজ ও বিভিন্ন ফলজ গাছ ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। শুধু তাই নয়, এতে বহু জুম্ম পরিবারের জুমভূমি এবং অনেক পাহাড় কাটার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। আমরা ২০২১ সালে আগষ্টে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বরাবর স্মারকলিপি প্রেরণ করেছি। তারপরও এখনও পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। তাই উপর্যুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।
এমনকি সিজকছড়াসহ সাজেক সীমান্ত সড়কে পার্শ্ববর্তী নিজ ভোগদখলীয় জমিতে জুম্ম গ্রামবাসীদেরকে বাড়িঘর নির্মাণ করতে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। যেমন গত ১২ নভেম্বর ২০২২ বিজিবি’র ২৭ ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডিং অফিসার (সিও) লেঃ কর্নেল মোঃ শরীফুল আবেদ (এসজিপি) ও বাঘাইছড়ি ইউএনও সাজেকে এসে জুম্মদের বাড়ি না তুলতে নির্দেশ দিয়ে যান। ১৩ নভেম্বর ২০২২ বিজিবি’র একদল সদস্য এসে বড় কমলাক পাড়া গ্রামের ৪ গ্রামবাসীর বাড়ি ভেঙে দিয়ে যায় এবং ২টি বাড়ি নির্মাণে বাধা দিয়ে বাড়ির খুটি ও গাছ-বাঁশগুলো ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এছাড়া সেনাবাহিনী ও বিজিবি বিভিন্ন জায়গায় চেকপোষ্ট বসিয়ে এলাকাবাসীদেরকে এলোপাতাড়ি তল্লাসী করে চলাচলে বাধা প্রদান করে চলেছে।
আরও উল্লেখ্য যে, আমরা অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ির অন্যান্য ইউনিয়ন, লংগদু, কাউখালী, বরকল, নানিয়ারচর এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা থেকে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষ যারা অনেক পরিশ্রমে গড়ে তোলা বিভিন্ন বাগান-বাগিচা ও জুম চাষ করে জীবন অতিবাহিত করে থাকি। আমাদের পূর্বপুরুষরা অধিকাংশই কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তুচ্যুত।
বাঘাইছড়িতে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন
আমরা অনেক আশায় বুক বেঁধেছিলাম যে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশন কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হবে ও টাস্কফোর্স কর্তৃক আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন পাবে। কিন্তু বিগত প্রায় ২৫ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন না হওয়ায় আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও হতাশার মধ্যে দিনযাপন করছি।”
স্মারকলিপিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়ঃ
১. অবিলম্বে সাজেক সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম পরিবারসমূহের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২. সাজেক সীমান্ত সড়কের পার্শ্ববর্তী জুম্মদের নিজস্ব জায়গা-জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণে বাধা প্রদান অবিলম্বে বন্ধ করা।
৩. অবিলম্বে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪. অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্টমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের বরাবরেও স্মারকলিপির অনুলিপি প্রেরণ করা হয়।