হিল ভয়েস, ৯ এপ্রিল ২০২৩, বান্দরবান: বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে বহিরাগত সীগাল হোটেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ‘সীগাল বোর্ডিং স্কুল’ স্থাপনের নামে স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের ভোগদখলীয় ১৫০ একর ভূমি বন্দোবস্তী ও বেদখলের প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে স্থানীয় ভুক্তভোগী জনগণের উদ্যোগে এক মানববন্ধন আয়োজন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে ও মানববন্ধনে পাড়াবাসীকে উচ্ছেদ করে সীগালকে জমি প্রদান প্রক্রিয়া বাতিল, যারা এই অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর আবেদন জানানো হয়েছে। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এতে অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের দায় নিতে হবে বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আজ (৯ এপ্রিল ২০২৩) সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর উপজেলা চত্বরে ‘সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ভুক্তভোগী জনসাধারণ’ এর ব্যানারে এই মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রেরণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য ঞো থোয়াই প্রু মারমা মিলন, একই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মংয়ে মারমা, ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মংচথোয়াই মারমা, ইউপি সদস্য উক্যহ্লা মারমা, সুই থোয়াই চিং মারমাসহ বিভিন্ন গ্রামের ৩ শতাধিক মারমা গ্রামবাসী।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা উপরোল্লিখত চারটি পাড়ায় (লামার পাড়া, কেয়াং পাড়া, চিংথোয়াই পাড়া ও জুমখোলা) ৩৫০টি পরিবার যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছি। সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ভূমি অফিসের একটি নোটিশের ভিত্তিতে অবহিত হয়েছি যে, পাড়াবাসীর বন্দোবস্ত ও ভোগদখলীয় মালিকানায় বংশপরম্পরায় জীবিকা নির্বাহ করে আসা জমি থেকে ১৫০ একর জমি ক´বাজারের হোটেল সীগাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার জন্য পরিমাপ ও তদন্ত করা হবে। সেখানে হোটেল সীগাল কর্তৃপক্ষ সীগাল ইন্টারম্যাশনাল বোর্ডিং স্কুল করবে। যা শুনে আমরা পায়ের তলার মাটি ও জীবনজীবিকা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি।’
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বহিরাগত ভূমিদস্যুরা লোভনীয় প্রলোভনে বান্দরবানে ভূমি দখল করতে আসে। হোটেল সীগাল কর্তৃপক্ষও সেই একই কৌশলে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কিছু দালালকে ব্যবহার করে আমাদের উপরোল্লিখিত পাড়াবাসীর ভূমি দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। উল্লেখিত ১৫০ একর জমির উপর নির্ভর করে সরাসরি ১০০-১২০টি মারমা পরিবার বংশপরম্পরায় জীবনজীবিকা নির্ভর করে। তাদের কারও কারও ভূমি বন্দোবস্তও রয়েছে। অনেক পরিবার আইন, প্রচলিত রীতি, প্রথা ও পদ্ধতি অনুসরণ করে ভোগদখলীয় মালিকানায় ফলদ-বনজ বাগান, জুমচাষ ও শাকশবজি চাষ করে থাকেন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্যিক বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা হোটেল সীগালের টোপ মাত্র। আসল লক্ষ্য পর্যটন ও হোটেল ব্যবসার জন্য ভূমিদখল।’
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘উল্লিখিত ১৫০ একর ভূমি প্রদান করা হলে সরাসরি ১০০-১২০ পরিবার ভূমি হারাবে এবং ক্রমান্বয়ে তৎসংলগ্ন পাঁচটি পাড়াবাসীর সমস্ত ভূমিও দখল-বেদখল হয়ে যাবে। এতে একদিকে পাঁচটি পাড়া ৩৫০টি পরিবার জীবন-জীবিকা হারাবে, অপরদিকে চিরচেনা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বদলে গিয়ে পাড়াবাসী অচেনা জগতে সামাজিক গোপনীয়তা হারিয়ে টিকে থাকতে পারবে না।’
স্মারকলিপিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, ইতিপূর্বেও রাবার ও হর্টিকালচারের জন্য ভূমি ইজারা প্রদানের কারণে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে (২০০৬ থেকে ২০১৪ সালে) আটটি চাক ও মারমা পাড়া উচ্ছেদ হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া শতাধিক পরিবার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আপনি অবগত আছেন যে, ১৯৮৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বন্দোবস্ত বন্ধ রয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর বহিরাগত কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কোনো ধরনের ভূমি হস্তান্তর না করার বিধিনিষেধ রয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতিপ্রথা অনুযায়ী বন্দোবস্ত ও ভোগদখলীয় মালিকানায় থাকা ১৫০ একর ভূমি বহিরাগত হোটেল সীগালকে বন্দোবস্ত প্রদানের প্রক্রিয়া চালানো সম্পূর্ণ অবৈধ ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি বিরোধী।’
উল্লেখ্য, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মোঃ অহিদ উল্লাহ কর্তৃক ২৮ আগষ্ট ২০২২ ইস্যুকৃত এক নোটিশ মূলে জানা যায় যে, নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি ইউনিয়নের সোনাইছড়ি মৌজায় আন্তর্জাতিক মানের সীগাল বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠার নামে ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) একর ভূমি বন্দোবস্তী পাওয়ার জন্য কক্সবাজারের হোটেল মোটেল জোনের সীগাল ব্রাঞ্চের সীগাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান মাসুম ইকবাল আবেদন করেন।
মাসুম ইকবালের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য আবেদনকারীকে বা তার মনোনীত সার্ভেয়ার বা প্রতিনিধি নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি ভূমি অফিসে আগামী ১১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখ উপস্থিত থাকার জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি অফিস থেকে উক্ত নোটিশ জারি করা হয়।
উক্ত নোটিশে কত ভাগ জমিতে অবকাঠামো স্থাপন করা হবে, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় কী উদ্যোগ নেয়া হবে, পর্যটন উন্নয়নে কী অবদান রাখবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কী অবদান রাখবে, স্থানীয় বাসিন্দারা কী সুবিধা পাবে ইত্যাদি তথ্য নিয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
#নাইক্ষ্যংছড়িতে স্কুলের নাম ব্যবহার করে ১৫০ একর ভুমি দখলের পাঁয়তারা
উল্লেখ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার নামে বহিরাগত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জুম্মদের হাজার হাজার একরের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি বেদখল, জুম্মদের উচ্ছেদ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অনেক উদাহরণ রয়েছে।
তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক স্কুলের নামে নানা কৌশলে ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে লামায় ম্রো জনগোষ্ঠীসহ জুম্মদের ২,০০০ একরের মতো জায়গা-জমি দখল এবং কয়েকটি গ্রামের ম্রো অধিবাসী উচ্ছেদের অভিযোগ রয়েছে।
অনুরূপভারে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কর্তৃকও শিক্ষা সুবিধা দেয়ার নামে জুম্মদের শত শত একর ভূমি বেদখলের উদারহণ রয়েছে। এমনকি সহজে সুবিধা লাভের জন্য সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ প্রকল্প হাতে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে।