হিল ভয়েস, ৬ এপ্রিল ২০২৩, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকার ৩ নং ওয়ার্ডের বাইশফাঁড়ি ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যদের কর্তৃক এক তঞ্চঙ্গ্যা নারীকে নির্যাতন ও গ্রামবাসীদের মারধরের পর উল্টো জুম্ম গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে বিজিবি কর্তৃক মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ২ এপ্রিল ২০২৩ কক্সবাজার ব্যাটেলিয়ন (৩৪ বিজিবি) এর পক্ষ থেকে জেসিও ৯৭৪৯ বিএম রেজাউল করিম বাদী হয়ে জুম্মদের বিরুদ্ধে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় এই মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
বিজিবি কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলার ভুক্তভোগীরা হলেন- ১. কানতুমং তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পীং- মৃত নিতাইনু তঞ্চঙ্গ্যা ২. চুতিঅং তঞ্চঙ্গ্যা (৩৬), পীং- মৃত রিমু তঞ্চঙ্গ্যা ৩. সুমং তঞ্চঙ্গ্যা (২৮), পীং- মংলা প্রো তঞ্চঙ্গ্যা ৪. রইশং তঞ্চঙ্গ্যা (৬০), পীং- মৃত ধছাইং তঞ্চঙ্গ্যা ৫. চাউমাউ তঞ্চঙ্গ্যা (৩২), স্বামী হারাঙ তঞ্চঙ্গ্যা, ৬. উছামিয়া তঞ্চঙ্গ্যা (২০), পীং- হারাঙ তঞ্চঙ্গ্যা,৭. ইচাইন তঞ্চঙ্গ্যা (২৩), পীং- চৈতা তঞ্চঙ্গ্যা, ৮. বাবু তঞ্চঙ্গ্যা (২৩), পীং- পুমিয়াচিং তঞ্চঙ্গ্যা, ৯. মাছুয়ে তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পীং- মংসাইলা তঞ্চঙ্গ্যাসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৩০-৪০ জন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিত্যদিনের মত তিনজন তঞ্চঙ্গ্যা নারী বিকালের দিকে তাদের পালিত ছোট বড় ৫ টি গরু ক্যাম্পের পাশ দিয়ে নিয়ে আসার সময় কয়েকজন বিজিবি সদস্য অপ্রাসঙ্গিক নানা জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করলে বিজিবি সদস্যদের সাথে ওই নারীদের বাকবিতন্ডা হয়। গরুগুলো তোমাদের নাকি, বার্মা গরুর মনে হচ্ছে ইত্যাদি নানা অবান্তর কথা বলে বিজিবি সদস্যরা ওই নারীদের নাজেহাল করার চেষ্টা করে।
এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা তিনজন নারী থেকে একজনকে ক্যাম্পের ভিতরে জোর করে টেনে নিয়ে যায় এবং ক্যাম্পের ভিতরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। সেই মুহূর্তে পাড়ার ১০-১৫ জন লোক ক্যাম্পে গিয়ে প্রতিবাদ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত বিজিবি সদস্যরা ওই নারীকে ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে কয়েকজন গ্রামবাসী মিলে ওই নারীকে উখিয়া উপজেলা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যান।
সেই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে বিকাল আনুমানিক ৫.৩০ টার দিকে ৩৪ বিজিবি সিও ক্যাম্পে আসেন। সিও আসার খবর পেয়ে লোকেরা ক্যাম্পের গেইটে গিয়ে সুস্থ বিচারের দাবি জানাতে যান। কিন্তু সিও আসার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পাহাড়িকে জোর করে ক্যাম্পের ভিতরে ধরে নিয়ে যান।
পাড়াবাসীর মধ্যে আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পাড়াবাসীরা সবাই শত শত নারী-পুরুষ ক্যাম্পের গেইটে এসে প্রতিবাদ করতে থাকে। শত শত মানুষ গেইটে গিয়ে জুম্ম নারীকে মারধর এবং সিও আসার পরও আরো দুজন মানুষকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রতিবাদ করতে থাকে গ্রামবাসীরা।
একপর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা কোনো কারণ ছাড়া পুরো গ্রামের ভিতরে গিয়ে নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধসহ সবাইকে মারধর ও হামলা করতে থাকে। বিজিবি সদস্যরা প্রায় ২-৩ ঘন্টা পর্যন্ত গ্রামবাসীদের উপর সেই মারধর হামলা চালায়। বিজিবি সদস্যদের হামলায় অনেক নিরীহ বৃদ্ধ বয়সী মহিলারা পর্যন্ত রেহাই পায় নাই।
এরপরে বিজিবি সিও ক্যাম্পের ভিতর থেকে রাস্তায় বের হয়ে আলোচনার করার প্রস্তাব দেন। সেই সময় চারিদিকে বিজিবি সদস্যদের পাহাড়ায় রেখে আলোচনা করা হয়। সেই আলোচনায় ঘুমধুমের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ, ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আলম, ক্যলাচিং কারবারী, মংপোলাইন কারবারী, অংলাচাসহ আরো একজন বৃদ্ধ আদিবাসী উপস্থিত ছিল বলে জানা যায়।
সেই নারীদেরকে কেন মারধর করা হয়েছিল বলে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানান গ্রামের কার্বারীরা। তারা বলেন, যারা প্রকৃত চোরাকারবারী তাদেরকে ধরেন ও মামলা করেন তাদের কোন আপত্তি নাই।
সেই আলোচনা চলাকালীন সময়ও আরো দুজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখা হয়। এনিয়ে সর্বমোট ৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীদের জোর করে ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখা হয়।
তখন কারবারীরা আটককৃত নিরীহ ৪ জন গ্রামবাসীকে ছেড়ে দিতে দাবি করেন৷ তখন বাঙালি চেয়ারম্যান ও বাঙালি মেম্বার কিছুই না বলে চুপ করে থাকে।
অবশেষে ৩৪ বিজিবি সিও জানিয়ে দেন যে, আটকিয়ে রাখা ৪ জনের বিরুদ্ধে পুলিশকে দিয়ে মামলা করা হবে৷ তবে এলাকার কাউকে আর আসামী করা হবে না বলে আশ্বাস দেন।
বিজিবি সদস্যদের হামলায় অনেক নিরীহ বৃদ্ধ বয়সী নারীরা পর্যন্ত রেহাই পায় নাই। এমনকি একটা বাড়ির পার্শ্বে অবস্থিত সেন্ট্রি পোস্ট থেকে হঠাৎ করে নেমে এসে বাড়িতে অবস্থান করা বৃদ্ধ নারীকে গুরুতর জখম করা হয়।
উল্লেখ্য যে, গত ১০-১২ বছর আগে স্থানীয় গ্রামবাসীদের বাধা সত্ত্বেও একদম পাড়ার মাঝখানে জোর করে বিজিবি ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়েছিল। তখন ক্যাম্প করতে বাধা দিলে ৬ মাস অবস্থান করার কথা বলে পাড়ার কারবারী থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। সেই ক্যাম্পটি দুই জনের খতিয়ানভুক্ত জোত মালিকানাধীন জমির উপর স্থাপন করা হয়।
ক্যাম্পটি স্থাপন করার পর থেকে পাড়াবাসীদের সাথে অনেক সমস্যা হয়ে আসছে। পাড়ার নারীরা আগের মত চলাচল ও স্নান করতে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় বলে জানা যায়।
ঘটনার দিন ৩৪ বিজিবি কমান্ডার ৪ জনকে মামলা করার কথা বললেও পরের দিন পুরো গ্রামের ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলা দায়ের করেন।