হিল ভয়েস, ২ মার্চ ২০২৩, বান্দরবান: রুমা ও বিলাইছড়িতে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে গ্রামবাসীদেরকে হুমকি, ৪ জন তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে অপহরণ ও দুই দিন হয়রানির পর মুক্তি, অন্তত ২টি স্কুল দখল করে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীর অবস্থান, ভয়ে অন্তত ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর নির্দেশ দিলে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের গঙ্গাছড়া (টাইগার পাড়া) থেকে পাড়ার কার্বারী (গ্রাম প্রধান) সহ ৪ জন তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসী রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের আর্থাহ পাড়ায় কেএনএফের সাথে দেখা করতে যান।
এ সময় বমপার্টির সন্ত্রাসীরা তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীদেরকে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। কেএনএফ হুমকি দেয় যে, পরবর্তী একমাসে তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বড়থলি, মন্নুয়াম পাড়া ও এর আশেপাশের সেনাক্যাম্পগুলো চিরুনী অভিযান চালাবে। এই সময়ে সামনে যাকে পাবে তাকেই তারা গুলি করবে। এমনকি শিশু-বৃদ্ধ হলেও তারা ছাড় দেবে না।
তবে একমাস চিরুনী অভিযানের পরে এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ থেকে সকলেই আবার যে যার গ্রামে ফিরতে পারবে এবং নিজ নিজ জুমের কাজ করতে পারবে বলে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা উল্লেখ করে।
দেখা করতে যাওয়া ৪ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে দুইদিন পর্যন্ত আটকে রেখে হয়রানি করার পর গত ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি ছেড়ে দেয় বমপার্টির সন্ত্রাসীরা। ভুক্তভোগী গঙ্গাছড়ার গ্রামবাসীরা হলেন- পুরিহিত তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে কালিন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (৫৮), সুরঙ্গ তঞ্চঙ্গ্যার রুইধন তঞ্চঙ্গ্যা (৫৫), লজিয়ং তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে আলদ্বগা তঞ্চঙ্গ্যা (৪৬) ও জুগামন তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে নোইয়া তঞ্চঙ্গ্যা (৩৯)।
স্থানীয় সূত্র আরো জানায় যে, রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাকনিয়ার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দখল করে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা নিজেদের ক্যাম্প করে ফেলেছে।
বমপার্টির হুমকিতে পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আরথাহ্ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাসত্লাং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের পাকনিয়ার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুননুয়াম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জেসপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই ৬টি স্কুল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির ভিত্তিতে জুম্ম জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর মদদে ও প্রশ্রয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলাভমেন্ট অর্গানাইজেন (কেএনডিও) নামে এই বমপার্টি গঠিত হয়। এরপর ২০১৬ সালে এই সংগঠনের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে পরিবর্তন করা হয়।
কিন্তু একপর্যায়ে ২০২০ সাল থেকে বমপার্টি অর্থের বিনিময়ে রুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের আস্তানায় ‘জামায়াতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠনকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। ফলে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে যৌথবাহিনী জামায়াতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়ার সশস্ত্র জঙ্গী এবং তাদের আশ্রয় প্রদানকারী বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করে।
এরপর বমপার্টি সন্ত্রাসীরা নানা হুমকি ও উৎপীড়নের মাধ্যমে রুমা, রোয়াংছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গ্রামবাসীদেরকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে চলেছে এবং দেশে-বিদেশে সহানুভূতি আদায়ের উদ্দেশ্যে বম গ্রামবাসীদেরকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করছে।
ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে বম জনগোষ্ঠীর অনেক লোকজন মিজোরাম রাজ্যের লংত্লাং জেলার চংতে মহকুমার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করে। তারই ফলশ্রুতিতে এ পর্যন্ত পার্ভা-৩ এলাকায় ২১৫ জন, চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় ৬৮ জন, মাউত্লাং এলাকায় ৪৬ জন, ভাথুয়ামপুই এলাকায় ৬০ জন, মংবু এলাকায় ১০১ জন, সাউথ বুংত্লাং এলাকায় ১০ জন, রুইতেজল এলাকায় ২৯ এবং মুন্নয়াম এলাকায় ১২ জন মোট ৫৪২ জন বম জনগোষ্ঠীর লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
গত বছর থেকে এযাবৎ ২২ জনকে অপহরণ, কমপক্ষে ৭ জনকে হত্যা, প্রায় দুই ডজন গ্রামের এক হাজারের বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ও মারমা অধিবাসী উচ্ছেদের ঘটনা সংঘটিত করে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা।