হিল ভয়েস, ২২ মার্চ ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অব্যাহত টহল অভিযানে সেনা সদস্যদের কর্তৃক প্রায় নিয়মিত নিরীহ আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদের মারধর, হয়রানি, হুমকি প্রদান ও বাড়ি তল্লাসি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ১৯ মার্চ ২০২৩ সেনাবাহিনী কর্তৃক ৬ নিরীহ মারমা গ্রামবাসীকে বেদম মারধর, গত ১৭ মার্চ ২০২৩ একটি পাংখোয়া গ্রাম ও একটি মারমা গ্রামের সকল বাড়িতে তল্লাসি ও হয়রানি এবং এর পূর্বে জনসংহতি সমিতির গ্রাম কমিটির এক সভাপতিকে আটক ও হয়রানি ও এক ধর্মীয় সংখ্যালঘু দোকানদারকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রায়ই সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রামে গ্রামে গিয়ে টহল অভিযান চালিয়ে এবং অবস্থান করে গ্রামবাসীদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ মার্চ ২০২৩ বিলাইছড়ির ধুপশীল সেনা ক্যাম্পের টুআইসি মেজর রেজার নেতৃত্বে ৪০ জনের একটি সেনাদল শালবাগান হয়ে লতাপাহাড়ের পাংখোয়া পাড়ায় গিয়ে অবস্থান নেয়। অপরদিকে একই সময়ে ফারুয়া সেনা ক্যাম্প হতে জনৈক সুবেদারের নেতৃত্বে একটি সেনাদল লতাপাহাড়ের মারমা পাড়ায় গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে ওই দুটি সেনাদল পাংখোয়া পাড়া ও মারমা পাড়া উভয় গ্রামের ঘরে ঘরে ব্যাপক তল্লাসি চালায়। তল্লাসির সময় সেনা সদস্যরা গ্রামবাসীদের ‘অস্ত্র আছে কিনা, সন্ত্রাসী আসে কিনা ইত্যাদি’ নানা হয়রানিমূলক প্রশ্ন করেন। এছাড়া সেনা সদস্যরা তাদের অনুমতি ছাড়া গ্রামের কোনো লোকজন কোথাও যেতে পারবে না বলে নির্দেশ প্রদান করেন।
গত ১৯ মার্চ ২০২৩ উক্ত সেনাদলের লোকেরা লতা পাহাড় এলাকার মারমা গ্রামের ৬ গ্রামবাসীকে বিনা অপরাধে মারধর করেন। ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা হলেন- (১) গ্রামের কার্বারি উহ্লা প্রু মারমা (৫৫), পীং-থুই চানু মারমা, (২) গ্রামের কার্বারি মিদু মারমা (৫১), পীং-হ্লাব্রেচাই মারমা, (৩) থুইচা প্রু মারমা (৩৫), পীং-সক্রা অং মারমা, (৪) উহ্লা অং মারমা (৩৫), পীং-রুই পা উ মারমা, (৫) কন্যাবাবু তঞ্চঙ্গ্যা (৩০), পীং-অর্জুন তঞ্চঙ্গ্যা ও (৬) অনিল তঞ্চঙ্গ্যা, পীং-অর্জুন তঞ্চঙ্গ্যা। উল্লেখ্য যে, উক্ত গ্রামবাসীদের মারধর করার পর সেনা সদস্যরা বলে যে, এই মারধরের কথা যেন বাইরের কারও নিকট প্রকাশ করা না হয়। এই মারধরের কথা বাইরে প্রকাশ পেলে এবং সেকথা যদি সেনাবাহিনী জানে, তাহলে আবার সবাইকে ধরে নিয়ে মারধর করে থানায় সোপর্দ করে জেলে পাঠানো হবে বলে হুমকি দেয় সেনা সদস্যরা।
প্রায় ৪/৫ দিন উক্ত গ্রামে অবস্থান গ্রহণ ও গ্রামের লোকদের হয়রানি করার পর গত ২১ মার্চ ২০২৩ বেলা ২ টার দিকে উভয় সেনাদল সেখান থেকে চলে যায়।
স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, গত ১৭ মার্চ ২০২৩ মেরাংছড়া সেনা ক্যাম্প হতে সুবেদার মাহতাব এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল বেগেনাছড়ি গ্রাম হয়ে ২নং কাঙারাছড়ি ইউনিয়নের বটতলী মৌন পাহাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরদিন (১৮ মার্চ) সকালে ওই সেনাদলটি আবার বেগেনাছড়ি গ্রামে আসে এবং বেগেনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে সারাদিন অবস্থান গ্রহণ করে সারা রাত কাটিয়ে পরদিন সেনাদলটি তাগলকছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় এবং সেখানেই রাত কাটিয়ে পরদিন (২০ মার্চ) বেলা ২টার দিকে সেখান থেকে ক্যাম্পে ফিরে যায়।
স্থানীয়রা জানান, এভাবে প্রায় প্রতিদিন বিলাইছড়ির কোনো না কোনো এলাকায় টহল অভিযান চলমান চালানো হয়। এসময় সেনা সদস্যরা গ্রামবাসীদেরকে ‘তারা সন্ত্রাসীদের চাঁদা দেয় কিনা, অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা, সন্ত্রাসীরা কোন দিকে চলাফেরা করে’ ইত্যাদি প্রশ্ন করে হয়রানি করে এবং সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে বলে জানায়। অপরদিকে, গ্রামবাসীরা যখন সেনামদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয় এবং তাদের অবস্থান বিষয়ে জানায় তখন সেনা সদস্যরা ‘না না, তারা নয়’ বলে উল্লেখ করে এড়িয়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, গত ৭ মার্চ ২০২৩ গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’এর দুই সদস্য জনসংহতি সমিতির কাঙারাছড়ি ইউনিয়নের ভালাছড়ি গ্রাম কমিটির সভাপতি ভদ্রসেন চাকমা (৫২), পীং-মৃত বিরাজ মোহন চাকমাকে বিলাইছড়ি বাজারে প্রয়াত গুঞ্জু বড়ুয়ার দোকানে জোরপূর্বক আটক করে রাখে। এসময় ডিজিএফআই সদস্যারা ভদ্রসেন চাকমাকে ‘তুমি নাকি জনসংহতি সমিতির চাঁদা সংগ্রহ কর, কত টাকা আদায় করে পাঠিয়েছ, তুমি নাকি কাঙারাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রামাচরণ মারমা রাসেলকে ও সংস্কারপন্থীদের চাঁদা সংগ্রহকারী নাগজ্যা চাকমাকে মারতে এসেছে ইত্যাদি’ প্রশ্ন করে হয়রানি ও বিব্রত করার চেষ্টা করে।
এরপর ডিজিএফআইয়ের এক সদস্য থানার দিকে চলে যায়। এসময় বিপদের আশঙ্কা মনে করে ভয়ে ভদ্রসেন চাকমা সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই সেখানে সেনাবাহিনীর একটি দল আসে এবং দোকানে ভদ্রসেন চাকমাকে না পেয়ে তারা দোকানদার রুবেল বড়ুয়াকে বেদম মারধর করে।
পরে সেনাবাহিনী ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার ভুবনজয় চাকমার মাধ্যমে পরদিন (৮ মার্চ) সকালে ভদ্রসেন চাকমাকে দীঘলছড়ি সেনা জোনে হাজির হওয়ার নির্দেশ পাঠায়। কিন্তু ভদ্রসেন চাকমা বিনাবিচারে মারধর, আটক ও মিথ্যা মামলার ভয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আসেনি। ৮ মার্চ ২০২৩ সকাল ৮ টার দিকে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই’এর একটি দল ভদ্রসেন চাকমার বাড়ি গিয়ে বাড়িতে তল্লাসি চালায় এবং বাড়ির লোকদের সেনা ক্যাম্পে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়ে যায়।
বর্তমানে ভদ্রসেন চাকমা সেনাবাহিনীর ভয়ে ও নিরাপত্তার অভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী এক গ্রামবাসী বলেন, সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা ঘোরাফেরা করছে এবং নিয়মিত জোরপূর্বক চাঁদা তুলছে। কিন্তু সেনাবাহিনী সেসব দেখেও না দেখার ভান করছে। অথচ জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কর্মী ও সমর্থকদের নানাভাবে নিপীড়ন ও হয়রানি করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী নিজেরাই সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে এবং একের পর এক অভিযান চালিয়ে নিরীহ জনগণের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।